বার বার আগুনের বিভীষিকা

রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় প্রায়ই বিভীষিকাময় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। ফলে প্রাণহানি, আহত হওয়ার ঘটনা ও সম্পদের ক্ষতি বেড়েই চলেছে। অগ্নিকাণ্ডে বছরে কয়েকশ’ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। তবু অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেই। ফলে বার বার অগ্নিকাণ্ডে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে, একই সাথে ধ্বংস হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ভবন বা স্থাপনা মালিকদের উদাসীনতা এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এ সংকট কাটছে না। একেকটা অগ্নিকাণ্ডে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। আর ভবন নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা চিঠি চালাচালি করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। এটি যেন এখন নিয়ম হয়ে গেছে।

সর্বশেষ শনিবার (২১ আগস্ট) সকালে রাজধানীর বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকার একটি ছয়তলা ভবনে আগুন লাগার চার ঘণ্টা পর তা নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করে। এতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও মূল্যবান অনেক সম্পদের ক্ষয়ক্ষয়তি হয়েছে।

এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, ভবনটি অনেক পুরনো। এখানে অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা ছিল প্রায় শূন্য। ভবনটিতে অনেক দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন নেভাতে দেরি হয়েছে। তারপর আগুনে কীভাবে লাগল বা কারা দায়ী সেই বিষয়ে তদন্ত করতে কিছু সময় লাগাবে বলে তিনি জানান।

অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বনানীর আগুন লাগা ওই ভবনে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি।

শনিবার (২১ আগস্ট) দুপুর একটার দিকে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শনে এসে তিনি একথা বলেন। রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকায় কেন, আগুনের বিভীষিকা পিছু ছাড়ছে না।

এবিষয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ও ফায়ার ডিফেন্স অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ১ হাজার ১৮৭টি, ঝুঁকিপূর্ণ ৩ হাজার ৫১৮টি স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতে রয়েছে ১ হাজার ৬৯টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৮৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা।

ঢাকায় এসব বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে উঠেছে অফিস, গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা, মার্কেট ও শপিংমল। এর অনেকরই সংশ্লিষ্ট সংস্থার বৈধ অনুমোদন নেই। মানা হয় নাই বিল্ডিং কোড। কারখানায় ছোট ছোট কক্ষে বসানো হয় ভারী যন্ত্রপাতি। অনেক অফিস ও কারখানায় আলাদা গুদাম না থাকায় ভবনের মধ্যেই বিভিন্ন তলায় মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। কখনো সেখানে থাকে না উঠানামার জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি ও জরুরি বহির্গমনের আলাদা কোনো পথ। অপরিকল্পিত অপ্রশস্ত সিঁড়ি অগ্নিকাণ্ডের সময় একটি ধোঁয়াভর্তি চিমনিতে রূপ নেয়।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় মানুষ, যেমনটি এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের বেলায় হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় অপ্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে একত্রে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে পদদলিত হয়ে হতাহত হন কেউ কেউ।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, গত একযুগে ছোটবড় মিলিয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৬ হাজার। এতে প্রাণ হারিয়েছেন দেড় হাজারের আধিক মানুষ। আহতের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। আর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

এরমধ্যে ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গরিব অ্যান্ড গরিব গার্মেন্টস গাজীপুরের নিহতের সংখ্যা ২১। একই বছরের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে সবচেতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এতে প্রাণ হারান ১২৪ জন এবং ১৪ ডিসেম্বর দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যার আশুলিয়ায় নিহতের সংখ্যা ২৯।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশন আশুলিয়ায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ১১১ জন। এরপর ২০১৬ সালে টঙ্গীর ট্রাম্পকো ফয়েলস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা ৪১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার মোড়ে অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা ৭০ জন।

এদিকে সংস্থাটির  পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আর সবচেয়ে কম অগ্নিকাণ্ড হয় সিলেট বিভাগে। ময়মনসিংহ বিভাগেও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা সিলেটের চেয়ে বেশি।

এর কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, অন্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় ঢাকার আয়তন, বয়স, ভবন ও মানুষের সংখ্যা, কারখানা সবই বেশি। তাই ঢাকায় ঝুঁকি ও দুর্ঘটনার হার বেশি।

অন্যদিকে চলতি বছরের ২২ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল পাটকল কপোরেশন (বিজেএমসি) ভবনে আগুন লাগে।

এ ব্যপারে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানিয়েছিলেন, এনেক্স ভবন-১ এর সপ্তম তলার একটি গুদামে আগুন লাগে। সেটি বিজেএমসির একটি গুদাম। আগুন লাগার সাথে সাথে যারা ভেতরে ছিলেন, সবাই বের হতে পেরেছেন। ফলে বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনা না ঘটলেও অনেক মূল্যবান কাগজপত্রসহ আসবাবপত্র পুরে যায়।

গত ২৩ এপ্রিল ভোর রাতে পুরান ঢাকার ৯/১১ আরমাটিয়ান স্ট্রিটের হাজী মুসা ম্যানসনে ছয়তলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যালের গোডাউনে আগুন লাগে। এতে ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়াসহ চারজন নিহত হন এবং আহত হন অনেকে। এ ঘটনায় বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদেরও ক্ষতি হয়।

গত ২৭ জুন ঢাকার মগবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণে নিহত হন ১০ জন। ওই ঘটনায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, ভবনের কোথাও গ্যাস জমে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

গত ৮ জুলাই বিকেলে নরায়ানগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার ছয় তলা ভবনে আগুন লাগে। প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরদিন বিকেলে আগুন নিভিয়ে ফেলার পর ৪৮ জনের পোড়া মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজন নিহত ও ১০ জন আহত হন। এ অগ্নিকাণ্ডে সর্বোমোট ৫২ জনের মৃত্যু হয়।

এছাড়া গত ৭ জুন ভোর রাতে মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে মহাখালী সাততলা বস্তিতে আবারো আগুন লাগে। পুড়ে যায় ২ শতাধিক ঘর। ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল একই বস্তিতে। তখন আড়াই শতাধিক বাড়িঘর পুড়ে যায়। এই বস্তিতে হাজারের বেশি বাড়িঘর রয়েছে। এসব ঘরে রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন। দোকানপাটে রয়েছে গ্যাসের সিলিন্ডার। নাজুক এসব সংযোগ লাইন থেকে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

২০১২, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালেও মহাখালী সাততলা বস্তিতে আগুন লেগেছিল। তখনো বস্তির কাঁচাঘর, বাসিন্দাদের জমানো সব সম্পদ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, বারবার আগুনের বিভীষিকা থেকেও মানুষ সতর্ক হচ্ছে না। এলাকাবাসী, ভবন মালিকসহ সরকারি সংস্থাগুলোর উদাসিনতা ও অবহেলায় যত্রতত্র অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে।

রাজধানীর পুরান ঢাকা দীর্ঘদিন থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের কয়েক হাজার গুদাম, কারখানা বা দোকানের বেশিরভাগের নিবন্ধন বা লাইসেন্সসহ কোনো কাগজপত্র নেই।

এসব ব্যবসায়ী এবং তাদের সহায়তাকারী স্থানীয় লোকজনের ভোটব্যাংক রয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কর্তৃপক্ষ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয় না। তারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিভাবেও শক্তিশালী এবং এ এলাকার ভোটব্যাংক হিসাবে নানাদিকে প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায় না।

এছাড়া ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা পরিবেশ অধিদপ্তর তারাও সেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সিটি করপোরেশন যারা এসবের লাইসেন্স দেয় বা তদারকি করে, তারাও সেটা সঠিকভাবে করেনি।

Leave a Reply

Translate »