কাজের সন্ধানে দিশেহারা মানুষ

করোনা সংক্রমণের কারণে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন হয়েছে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ। বাংলাদেশেও লকডাউন শিথিল করে সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও দিনমজুর ও নিম্ন-আয়ের মানুষের অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। তারা এখনো কাজের সন্ধানে ঘুরছেন মাঠেঘাটে। কিন্তু কোথাও মিলছে না কাজ। ফলে করোনার প্রভাবে বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা।

শহরে কাজ হারানো মানুষ কম টাকায় নতুন কোনো কাজ জুটিয়ে নিতে পারলেও, গ্রামের মানুষ নতুন কাজ পাচ্ছেন না। অনেকেই নির্ভর করছেন খণ্ডকালীন কাজ বা দিনমজুরির ওপর।

বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, দীর্ঘ মেয়াদি লকডাউনের কারণে দেশের শিল্পখাতসহ সকল কর্মক্ষেত্রেই বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আগামী কয়েক বছর কাজ হারানোর প্রবণতা থাকবে। যার প্রভাব সার্বিকভাবে অর্থনীতির ওপর পড়বে বলে তারা মনে করছেন তারা।

এদিকে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, করোনাকালে নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমায় ঢুকেছে। করোনার লকডাউনের মধ্যে ২০০০ ব্যক্তির ফোনকলের ওপর ভিত্তি করে এ জরিপ করেছে সংস্থাটি।

তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে, এই সংখ্যাটি কয়েক কোটি, যারা নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় ঢুকেছেন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এতে দাবি করে, করোনায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ফলে দেশে এখন কর্মহীন দারিদ্র্যের সংখ্যা ৪০ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই এখনো বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ওই সময় দেশে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়েছিল। নিম্ন আয়ের মানুষ যখন সেই ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে।

এর আগে গত জানুয়ারিতে গবেষণা সংস্থা সানেমের দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব শীর্ষক জরিপে বলা হয়, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। এর মধ্যে অতি দরিদ্র ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দেশব্যাপী খানা পর্যায়ের জরিপের উপর ভিত্তি করে এ তথ্য জানায় সংস্থাটি।

অপর গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে গত এপ্রিলে বলা হয়, মহামারিতে দেশে মোট শ্রমশক্তির তিন শতাংশেরও বেশি লোক কর্ম হারিয়েছেন এবং প্রায় দেড় কোটি লোক মহামারির প্রভাবে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন।

সস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২১ সাল শেষ হতে হতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মহীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

রাজধানীতে সিএনজি অটোরিকশাচালক আকবর আলী বলেন- লকডাউন উঠে গেছে, আয় রোজগার অনেক কমে গেছে। গত দুই সপ্তাহ আমাদের তেমন আয় নাই। খুব খারাপ অবস্থায় আছি। টাকার দরকার। তাই যে যা ভাড়া বলছে, কোনো রকম পোষালেই চলে যাচ্ছি। যাত্রীকম থাকায় কম ভাড়ায় বাধ্য হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। তিনশ’ টাকার ভাড়া টানতে হচ্ছে দেড়শ’-দুইশ’ টাকায়। তার ওপর রাস্তায় যানজটে বসে থাকতে হয়।

ফুটপাতের কাপর বিক্রেতা শাহজাহান মিয়া বলেন, লকডাউনের কারনে গত তিন মাসের ঘর ভাড়া দিতে পারি নাই।

লকডাউন উঠে গেছে, কিন্তু কোন বেচা-কেনা নাই। টুকটাক যা হচ্ছে তা দিয়ে সামান্য বাজার সদাই করে খাচ্ছি।  আগামী মাসে ঘর ভাড়া দিতে পারব বলে মনে হয় না। এছাড়া গত দুইটা ঈদে বউ-বাচ্চার নতুন পোশাক তো দিতে পারি নাই। এর মধ্যে মুখে একটু ভালো খাবারও তুলে দিতে পারি নাই।

বাসচালক ফরিদ হোসেন বলেন, লকডাউনের কারনে কামাই না থাকায় অনেক ঋন হয়ে  গেছি। এখন সেই টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে। সাথে দৈনন্দিন সংসার খরচ গোছাতে হিমশিম খাচ্ছি।

আমাদের ইনকাম তো যাত্রীদের ওপর নির্ভর করে, তারা উঠলেই কেবল আয় হবে। কিন্তু রাস্তায় যাত্রী খুবই কম। দুই ঘণ্টা যাবৎ অপেক্ষা করে একটা ট্রিপ পেলাম, তাও পূর্বের ভাড়ায়।

আজিজুর রহমান এসএসসি পাস করে পরিবারের অভাব ঘুচানোর জন্য চাকরির উদ্দেশে তিন বছর আগে জামালপুর থেকে ঢাকায় আসেন। পুরান ঢাকায় একটি প্লাস্টিক কোম্পানিতে ১৪ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছিলেন, কিন্তু করোনায় চাকরি চলে যায় আজিজুরের।

তিনি বলেন, করোনায় মালিকের আয় না থাকায় সাত মাসের বেতন ছাড়াই ছাঁটাই করে দেয়। তারপর দীর্ঘদিন বেকার ছিলাম, কিন্তু মা-বাবা ও পরিবারের ছোট ভাই-বোনের খরচ আমাকেই বহন করতে হয়। তাই চোখে-মুখে কোনো উপায় না দেখে শেষে এখন ঢাকাতে রিক্সা চালাই।

আমার পরিবার কিন্তু জানে না আমি ঢাকাতে রিক্সা চালাই, রিক্সা চালাই শুনলে তারা অনেক দুঃখ পাবেন, কিন্তু রিকশা চালানো ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আর কোন পথ খোলা নেই। আশায় আছি সামনে আবার একটা চাকরি পাব।

প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি হারিয়ে রাজধানীতে এখন সবজি বিক্রি করেন রাসেল আহমেদ।

তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের একটি চালের আড়তে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। লকডাউনেই চাকরি হারিয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশালে চলে যান। করোনায় নতুন কোনো কাজ না পাওয়ায় ৫ সদস্যের সংসার চালাতে প্রায় এক লাখ টাকা ঋণ করেন। কোন উপায় না দেখে সুদের ওপর আবার ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বর্তমানে ঢাকার হাতিরপুলে ভ্যানের ওপর আম ও সবজি বিক্রি করছেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, করোনাকালীন নতুন দরিদ্র বা কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের কোনো ডাটা নেই। কোনো সার্ভে করা হয়নি। তবে সামনে শুরু করব।

অন্য দেশে এ ধরনের জরিপ করা হলেও বিবিএস কেন করেনি, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, করি নাই কেন এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া তো মুশকিল। যেটা করা হয়নি সেটা বড় কথা না। সরকারি প্রতিষ্ঠান চাইলেই যখন তখন কোনো একটা সার্ভে করতে পারে না।

তার দাবি, জরিপ করলেও নতুন দরিদ্রদের বিষয়টি সেভাবে ফুটে উঠত না গবেষণায়।

তিনি বলেন, নতুন দরিদ্র কোনো স্টেবল বিষয় না। কোনো জরিপে ফল প্রকাশ পেতে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে। এক মাস যদি লকডাউন বাড়ে, তবে দেখা যাবে আজ কোনো জরিপ করলাম, রেজাল্ট বের হতে এক মাস সময় লাগে, তা ইনভেলিড হয়ে গেছে।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনা সংক্রমণের কারণে অতিদরিদ্র মানুষ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সর্বাধিক বিত্তবান মানুষ সেভাবে প্রভাবিত হয়নি।

যারা সমাজে বিত্তহীন, লাকডাউনের কারণে তাদের অবস্থা আরো খারাপের হয়েছে। অনেকেই পেশাচ্যুত হয়ে নতুন করে দরিদ্র শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হন।

আমরা যদি বিষয়টি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করি, তাহলে একই চিত্র প্রত্যক্ষ করা যাবে। বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কারো কারো মতে, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্থার জরিপে হয়ত কিছু ভুল থাকতে পারে। তবে সরকারের উচিত ছিল এ নিয়ে বড় ধরনের কাজ করা। যেহেতু তারা করেনি, তাই যারা করেছে তা মেনে নিতে হবে।

আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, সরকারের বিবিএসও তো শুরুতে ছোট সার্ভে করে বলেছিল দারিদ্র্য বেড়েছে। করোনায় শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিত্রে বড় কোনো পরিবর্তন তো আসেনি। তাই দরিদ্রের অবস্থা আবার ভালো হয়েছে সে রকম বলার কোনো কারণ নেই।

জিইডি (ডিপার্টমেন্ট অব জেনারেল (প্রোগ্রাম) এডুকেশন সদস্য শামসুল আলম বলেন, লকডাউন পরবর্তী সাধারণ মানুষ খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। যে কারণে প্রায়শই প্রশ্ন উঠতে শোনা যায়, ‘জীবন আগে, নাকি জীবিকা।’

দেশের বেশির ভাগ, বিশেষ করে যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং স্বল্প আয়ের মানুষ, তারা খুবই বিপাকে পড়েছেন।

তিনি বলেন, নতুন দরিদ্রদের নিয়ে সরকারি কোনো ফাইন্ডিংস না থাকলেও সরকার এটি পর্যবেক্ষণে রেখেছে। এবার হয়ত কোভিডের নতুন বাস্তবতায় বেশি সংখ্যক গরিব হয়েছে। তবে গরিব যখন হয় তা গরিবই। সব গরিবের ব্যথা ও যন্ত্রণা একই রকম।

দারিদ্র্যসীমার নিচে মেনে যাওয়াকে স্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ধরনের সংকটকালে হঠাৎ করে নিচে নেমে যাওয়া, এটা তো নতুন কোনো ব্যাপার না। এখন সরকারি উদ্যোগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আনতে কাজ হবে।

Leave a Reply

Translate »