আল-খারিজমির অবদান

আইকোনিক ফোকাস ডেস্কঃ তিখন আব্বাসীয় খলিফাদের যুগ। আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুনের শাসনামলকে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানীদের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তাঁর সময়ে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বেশ অগ্রসর হয়। খলিফা আল-মামুন জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুশীলনের জন্য দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা চিকিত্সক, বৈজ্ঞানিক, গাণিতিক, জ্যোতির্বিদ, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, কবি, আইনজীবী, মুহাদ্দিস, তাফসিরকারকদের তাঁর দরবারে জড়ো করেন। তিনি দারুল হিকমাহ বা বিজ্ঞান নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। সে সময় যে কজন বিজ্ঞানী খ্যাতি অর্জন করেন, মুসা আল-খারিজমি তাঁদের অন্যতম। তিনি মধ্যযুগের গণিতশাস্ত্রকে উন্নতির শীর্ষে তুলে ধরেন। খারিজমি ৭৮০ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার আরবসাগরে পতিত ‘আমু দরিয়া’ নদীর একটি দ্বীপের কাছে অবস্থিত খাওয়ারিজম নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মুসা ইবনে শাকির। মুসা আল-খারিজমি তাঁর ভাইদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ও সবচেয়ে বেশি মেধাবী। তিনি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি আরবি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তা ছাড়া তিনি হিব্রু ও গ্রিক ভাষায়ও সুপণ্ডিত ছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে আল-খারিজমি খলিফা আল-মামুনের দরবারে চাকরি গ্রহণ করেন। অল্প সময়ে খারিজমির প্রতিভায় খলিফা যারপরনাই মুগ্ধ হন। খলিফা আল-মামুনের সহায়তায় তিনি তাঁর দরবারে আজীবন কাটিয়ে দেন। খারিজমি অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যার ওপর নিরবচ্ছিন্ন সাধনা চালিয়ে যান।

 

মুসা আল-খারিজমি একাধারে ভৌগোলিক, জ্যোতির্বিদ, গাণিতিক ও দার্শনিক ছিলেন। খলিফা আল-মামুনের প্রচেষ্টায় আল-খারিজমি ৭৯ জন ভূতত্ত্ববিদসহ ‘সুরাত-আল-আরদ’ বা দুনিয়ার একটি বাস্তব রূপ তৈরি করেন। পরে পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কনে এটি মডেল হিসেবে গৃহীত হয়। আল-খারিজমির গবেষণার সূত্র ধরে পরে খ্যাতনামা মুসলিম জোতির্বিদ আল-ফারগানি (মৃত্যু ১০০০ সাল), আল-বাত্তানি (মৃত্যু ৯১৯ সাল) ও ইবনে ইউনুস (মৃত্যু ১০০০ সাল) অক্ষরেখা দ্রাঘিমা ও মণ্ডল বিষয়ে বিশেষ গবেষণা করেন। তাঁদের সিদ্ধান্তগুলো আধুনিক ইউরোপ অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করেছে। আল-খারিজমি ও তাঁর সহযোগী জ্যোতির্বিদরা ভূ-বিদ্যা সম্পর্কে একটি অতি সূক্ষ্ম গণনা করেছিলেন। তিনি ডিগ্রির মাপে পৃথিবীর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেছিলেন। এর আসল উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর আয়তন ও পরিধি নিরূপণ করা। এখানে উল্লেখ্য যে পৃথিবী গোল-এই নির্দিষ্ট ধারণা নিয়েই খারিজমি ও তাঁর সহকর্মীরা গবেষণা চালিয়েছিলেন। আল-খারিজমির দল ফোরাত নদীর উত্তরে পামিরার নিকটবর্তী সিনজিরার প্রান্তরে পরিমাপকার্য চালায়। এতে মধ্যরেখার ১ ডিগ্রির দৈর্ঘ্য পাওয়া যায় ৫৬ মাইল। এটি ছিল আশ্চর্য রকম একটি নির্ভুল হিসাব। কারণ পৃথিবীর প্রকৃত দৈর্ঘ্য এই মাপ অনুযায়ী নিরূপিত দৈর্ঘ্য থেকে মাত্র দুই হাজার ৮৭৭ ফুট কম।

 

আল-খারিজমির অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে অঙ্কশাস্ত্রের আবিষ্কার। বিশেষ করে বীজগণিতে তিনি মৌলিক অবদান রাখেন। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের মতে, মুসা আল-খারিজমি সর্বপ্রথম বীজগণিত আবিষ্কার করেন। তাঁর মতে, খারিজমি অন্যতম শ্রেষ্ঠ আরবি বীজগণিতজ্ঞ ছিলেন এবং মধ্যযুগের গণিতবিদ্যায় তিনিই সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। খারিজমির ‘হিসাব আল-জবর ওয়াল-মুকাবিলাহ’ নামক গ্রন্থ বীজগণিতের মৌলিক গ্রন্থ। অনেকের বিশ্বাস, আল-খারিজমির ‘আল-জবর’ কিতাব থেকেই ইউরোপীয়রা ‘আলজেবরা’ শব্দটি চয়ন করেছে।

 

আল-খারিজমির ‘হিসাব আল-জবর’ বারো শতকে জিরার্ড কর্তৃক লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়। তাঁর তর্জমা ষোলো শতক পর্যন্ত ইউরোপের প্রতিটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বীজগণিত বিষয়ে প্রধান ও প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরে অবশ্য ওমর খৈয়ামের বীজগণিত খারিজমির চেয়ে আরো উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত হিসেবে সমাদৃত হয়। আল-খারিজমি পাটিগণিতেও অবদান রাখেন। আরবদের মধ্যে তিনিই পাটিগণিতে সর্বপ্রথম সংখ্যাবাচক চিহ্নগুলো ব্যবহার করেন। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের শাসনামলে ৮৫০ সালে মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খারিজমি ইন্তেকাল করেন।

Leave a Reply

Translate »