আইকোনিক ফোকাস ডেস্কঃ ঈদ-উল-ফিতর অর্থ হচ্ছে ‘ রমজান শেষে উৎসব’। মুসলিমদের জন্য এটি অন্যতম বৃহৎ উৎসব। মুসলিমদের জন্য রমজান মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বাস করেন, পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করেন।
ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যাচ্ছে যে ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ঈদ উদযাপন করা হয়েছিল। হিজরি দ্বিতীয় সনে ঈদের প্রবর্তন করা হয়েছিল।
ইসলামের নবী যখন মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় যান, তখন সময়কে ভিত্তি ধরে হিজরি সাল গণনা করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্য হিজরি সাল গণনা শুরু করা হয়েছিল আরও ১৭ বছর পরে, খলিফা উমরের সময়ে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উদযাপনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি ভেদে নানা আচার-অনুষ্ঠান থাকলেও বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের জন্য ধর্মীয়ভাবে অভিন্ন কিছু রীতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঈদের নামাজ। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ঈদের নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত স্থান বেছে নেয়া হয়।
খোলা মাঠে নামাজ কেনঃ ইসলামের দৃষ্টিতে ঈদের নামাজের একটি সামাজিক গুরুত্বও রয়েছে। ইসলামের নবী মুহাম্মদ অনুসারীদের বলতেন, ঈদের নামাজে আসার সময় যার কাছে যা কিছু সর্বোত্তম কাপড় আছে সেটি পরিধান করে নামাজে আসার জন্য।
ইসলামের নবী মসজিদের পরিবর্তে খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ পড়তে পছন্দ করতেন। এর একটি বড় কারণ ছিল, এই নামাজের মাধ্যমে ইসলামের প্রতীক জোরালোভাবে তুলে ধরা। এজন্য তিনি নারীদেরও ঈদের নামাজে যোগ দেবার জন্য বলেছিলেন।
কানাডার ইসলামিক ইন্সটিটিউট অব টরন্টো’র সিনিয়র লেকচারার এবং খ্যাতনামা ইসলামিক পণ্ডিত শেখ আহমদ কুট্টি একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ঐতিহাসিকভাবে খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ পড়ার রেওয়াজ প্রচলন আছে। ইসলামের নবী খোলা জায়াগায় ঈদের নামাজ পড়তে পছন্দ করতেন। এর একটি কারণও আছে।
“খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে বয়স ও লিঙ্গভেদে মুসলিমদের মধ্যে সংহতি এবং ঐক্য প্রকাশের সুযোগ করে দেয়,” বলেন মি. কুট্টি।
তিনি লিখেছেন, যেখানে খোলা জায়গা নেই কিংবা ঝড়-বৃষ্টির কারণে খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ পড়া সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে যথাসম্ভব বড় জায়গায় নামাজ পড়া যেতে পারে।
মুসলিমরা মনে করেন, খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ আদায় করা নবীর সুন্নত। কারণ, ইসলামের নবীও খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করতেন। সেজন্য মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ার চেয়ে খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ পড়া বেশি গুরুত্ব দেন মুসলিমরা।
মুসলিমদের হাদিস গ্রন্থ সহিহ আল-বুখারিতে আবদুল্লাহ ইবনে উমরকে উদ্ধৃত করে বলা আছে, ইসলামের নবী ঈদের দিন অনেক সকালে খোলা মাঠে চলে যেতেন। তার সাথে থাকতো একটি লাঠি যেটির মাথা তামা দিয়ে ঢাকা থাকতো। সেই খোলা ময়দানে লাঠি পুঁতে দিয়ে সেটিকে সামনে রেখে ঈদের নামাজ পড়তেন তিনি।
উন্মুক্ত স্থানে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ নানা আয়োজন করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী ঈদগাহের পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ঈদের নামাজের বিশেষ আয়োজন করা হয়।
ঈদ পালনের কিছু নিয়ম ইসলামে নির্দিষ্ট করা আছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ঈদের দিন সকালে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা, যা সব মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয়।
আরও পড়ুনঃকখন বলব মাশাআল্লাহ, কখন বলব ইনশাআল্লাহ
এছাড়া ঈদ-উল ফিতরে ফিতরা প্রদান করাও একটি অবশ্য পালনীয় রীতি। ফিতরা ঈদের নামাজের আগে অসহায় গরিব-দুঃখীদের দিতে হয়। যখন প্রথম ঈদের প্রচলন চালু হয়, তখন এখনকার ঈদের মতো আতিশয্য ছিল না।
মদিনার অধিবাসী ও নবীর ঘনিষ্ঠ সহচর আবু সাঈদ আল-খুদরিকে উদ্ধৃত করে সহিহ আল-বুখারি হাদিস গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আজহার দিন সকাল বেলা ইসলামের নবী মুহাম্মদ খোলা মাঠে চলে যেতেন।
তিনি প্রথম যে কাজটি করতেন সেটি হচ্ছে নামাজ পড়া। এরপর তিনি ঘুরে দাঁড়াতেন এবং সমবেত মানুষদের উদ্দেশে কথা বলতেন। নামাজ পড়তে আসা মানুষজন তখনও তাদের সারিতে বসে থাকতেন। তিনি সমবেত মানুষকে নানা উপদেশ, আদেশ ও পরামর্শ দিতেন। এরপর নবী সে স্থান ত্যাগ করতেন।
তবে আবহাওয়া বৈরি থাকলে সেটি ভিন্ন কথা। ঝড়-বৃষ্টি থাকলে মসজিদের ভেতরে ঈদের নামাজ পড়া হতো। নবী মুহাম্মদের ঘনিষ্ঠ সহচর আবু হুরায়রার বর্ণনা থেকে সেটি পাওয়া যায়।
সুন্নাহ আবি দাউদ হাদিস গ্রন্থে আবু হুরায়রাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, একবার ঈদের দিন বৃষ্টি হয়েছিল। তখন নবী সবাইকে মসজিদের নিয়ে নামাজ পড়েছিলেন।
উন্মুক্ত ময়দানে ঈদের নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় আছে। এই নামাজের মাধ্যমে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন ইসলামের নবী মুহাম্মদ।
আরও পড়ুনঃসকাল-সন্ধ্যা আল্লাহকে স্মরণ করার ফজিলত
সবার অংশগ্রহণঃ ঈদের নামাজের মাধ্যমে একটি এলাকার মুসলিমদের একত্রিত হবার সুযোগ তৈরি হয়। ফলে তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব-বোধ জোরালো হয়।
ঈদের দিন নামাজে সবার উপস্থিতি কাম্য। ঈদের নামাজে যে কোনো বয়সের মানুষ অংশগ্রহণের বিষয়টি রেওয়াজ হিসেবে চলে এসেছে। সেখানে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ সবাই অংশ নিতে পারে। ঈদের নামাজে নারীদের অংশ নেবার বিষয়টি ‘উদার দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে এসেছে।
ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষকরা বলছেন, ঈদের নামাজে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। মসজিদ হচ্ছে একটি সীমাবদ্ধ কাঠামো। এখানে স্থান সংকুলানের বিষয় জড়িত আছে। উন্মুক্ত স্থানে নামাজ হলে সেখানে সবাই সহজভাবে যোগ দিতে পারে।
“ইসলামপূর্ব সমাজে নারীদের নানা ক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল, যেসব বিষয়কে ভুলিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। সেজন্য নারীদের ব্যাপারেও ঈদের নামাজে অংশগ্রহণের বিষয়টি উৎসাহিত করা হয়েছে। এবং যে জামাতে নারী ও শিশু সবাই অংশগ্রহণ করে সেটি হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর ও বৈষম্যহীন সমাজ,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম।
“প্রসারতা, উদারতা ও ব্যাপকতার বিষয়টি ফুটে ওঠে খোলা মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার মাধ্যমে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে আধ্যাত্মিকতা ও সেটির প্রসার হয় উন্মুক্ত ময়দানে নামাজ পড়ার মাধ্যমে।
ঈদে নামাজ কেনঃ ঈদের নামাজকে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন মাজহাবে বিভিন্নভাবে দেখা হয়। এটাকে সুন্নত, ওয়াজিব কিংবা ফরজে কিফায়া বা সামগ্রিক সমাজের বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি নির্ভর করে ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবের ওপর।
ঈদের নামাজ পড়তে হয় সূর্যোদয়ের পরে। ফলে ঠিক ফজরের নামাজের পরপর ঈদের নামাজ পড়া যায় না। তবে সূর্য মাঝ আকাশে আসার আগেই ঈদের নামাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য ইসলামি চিন্তাবিদরা সকাল সাথে থেকে দুপুর বারোটার আগে ঈদের নামাজ পড়ার কথা বলেন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, মুসলিমরা রমজান মাসের সন্তুষ্টি হিসেবে ঈদের দিন এই নামাজ পড়েন।
“শোকরানা এই জন্য যে রমজান মাস সবচেয়ে সৌভাগ্যের মাস এবং অন্য এগারো মাসের চেয়ে রমজান মাসের ফজিলত অধিক। রমজান মাস পার করতে পারলে মুসলিমরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেন। সেজন্য সন্তুষ্টি থেকে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়,” বলছেন অধ্যাপক ইব্রাহিম।
ঈদের নামাজের নিয়ম সাধারণত অন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের তুলনায় কিছুটা আলাদা। বিভিন্ন ইসলামি চিন্তাবিদদের ভাষ্য এবং গবেষণা থেকে দেখা যায় নবী মুহাম্মদ ঈদের দিন দুই রাকাত নামাজ পড়তেন।
আরও পড়ুনঃহজের ভিসা আবেদনের সময় বাড়ানো হল
সেই থেকে ঈদের সময় দুই রাকাত নামাজ পড়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে মুসলিমদের মধ্যে। এই নামাজকে বলা হয় ঈদের প্রধান আনুষ্ঠানিকতা।
“এটা অতিরিক্ত সালাহ্। এটা রমজানের সমাপ্তির পরে শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে এই সালাত আদায় করা হয়। এটা একটা শোকরানা সালাহ্,” বলছিলেন অধ্যাপক ইব্রাহিম।
“শুকরিয়া আদায়ের জন্য ঈদের নামাজ আয়োজন করা হয় এবং রমজান মাসের সার্থকতা এর মাধ্যমে পরিপূর্ণতা দান করা হয়,” বলছিলেন অধ্যাপক ইব্রাহিম।