আইকোনিক ফোকাস ডেস্কঃ চলমান ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে গত বৃহস্পতিবার মুখোমুখি হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব। কিন্তু তিনদিন আগে হয়ে যাওয়া দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের এই ম্যাচ নিয়ে এখনো চলছে আলোচনা।
শনিবার বিকেল থেকে স্থানীয় কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যে, সেই ম্যাচে ‘নারী আম্পায়ার থাকায়’ খেলতে আপত্তি জানানো হয়েছিল দু’দলের পক্ষ থেকেই।
বিষয়টি নিয়ে বিসিবির পক্ষ থেকেও গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়া হয়। রোববার এ নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে প্রাইম ব্যাংকও।
কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল সেই ম্যাচে? আম্পায়ার সাথিরা জাকির জেসিকে নিয়ে আসলেই কি কোন বিতর্ক হয়েছে?
সেই ম্যাচে খেলা দুই দল, ঐ দিনের ম্যাচ রেফারি, বিসিবি এবং ম্যাচটি কাভার করা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে বিষয়টি জানার চেষ্টা করে বিবিসি।
‘বিগ ম্যাচে অনভিজ্ঞ নারী আম্পায়ার কেন?’
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বোচ্চ আসর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ। লিস্ট এ মর্যাদার এই টুর্নামেন্টের জন্য ক্রিকেটাররা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন।
বৃহস্পতিবার মিরপুরে এই আসরের সুপার লিগের ম্যাচে মুখোমুখি হয় দুই বড় দল মোহামেডান স্পোর্টিং ও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট।
এই দুই দলে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করা তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদসহ বর্তমানে জাতীয় দলে খেলা বেশ কিছু ক্রিকেটার রয়েছে।
“আম্পায়ার তো আগে থেকে বলে দেয়া হয় না যে কোন মাঠে কে দায়িত্বে থাকবে,” বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার রহমান বিবিসিকে বলেন, “যে তথ্য পেয়েছি তা হল যখন তারা মেয়ে আম্পায়ার দেখছে, তখন তারা আলাপ করছে প্রাইম ব্যাংক-মোহামেডানের ম্যাচে এরকম অনভিজ্ঞ আম্পায়ার কেন দিলো?”
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এই কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেন, আলোচনাটা ছিল শুধুমাত্র অনভিজ্ঞতা নিয়ে, নারী বলে কোন প্রশ্ন তোলা হয় নি।
এ নিয়ে দুদলের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অভিযোগও জানায় নি। তবে দুই দলের কর্মকর্তার সাথে কথা বলেই এই আলোচনার ভিত্তি পাওয়া যায়।
“আমরা মাঠে এসে দেখছি নারী আম্পায়ার, তাকে কিন্তু আমাদের ক্রিকেটাররা অনেকেই চেনে। আমরা নিজেরা নিজেরা কথা বলছি ড্রেসিং রুমে যে মেয়ে আম্পায়ার আসছে এই প্রথম, কিন্তু লিখিত কোন অভিযোগ কিন্তু আমরা করিনি বা বাইরে কারো সাথেও বলিনি,” বলেন প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের ম্যানেজার শিকদার আবুল হাশেম কঙ্কন।
অনেকটা একই রকম প্রতিক্রিয়া মোহামেডানেরও।
“ড্রেসিং রুমে আমি ছিলাম আর কোচ ছিল, ক্রিকেটাররা কেউ ছিল না। তখন আমরা বলতেছিলাম যে এত বড় ম্যাচে না দিয়ে এই আম্পায়ারকে অন্য এক দুইটা ম্যাচ করায়া নিয়ে আসতে পারতো,” বলেন মোহামেডানের ক্রিকেট সমন্বয় তরিকুল ইসলাম টিটু।
তবে এই দুজনই প্রশ্ন তোলেন, যেহেতু তারা ক্লাবের পক্ষ থেকে কেউ কোন লিখিত অভিযোগ করেনি, তাহলে এই আলোচনাটা আসলো কীভাবে?
যদিও ওই মাঠে যিনি অ্যাম্পায়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তিনি অনভিজ্ঞ ছিলেন না, তবে এই লিগে প্রথমবার মাঠের আম্পায়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
সাথিরা জাকির জেসির আম্পায়ারিং কেমন ছিল?
বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত মেয়েদের সিরিজে দায়িত্ব পালন করছেন আম্পায়ার সাথিরা জাকির জেসি। একসময় জাতীয় দলের হলে খেলা এই ক্রিকেটার গত মার্চেই আইসিসির ডেভেলপমেন্ট প্যানেলে জায়গা করে নিয়েছেন। এছাড়া ধারাভাষ্যকার হিসেবেও তিনি পরিচিত।
এর আগে মেয়েদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ও বিদেশে লিগ ম্যাচও পরিচালনা করেছেন জেসি।
আর পুরুষদের ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগে খেলা পরিচালনা করলেও এই প্রথমবার দেশের সর্বোচ্চ লিস্ট এ ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে মাঠে দায়িত্ব পান তিনি।
এদিনের ম্যাচ রেফারি ছিলেন রকিবুল হাসান।
তিনি বলেন, “একটা ভালো ম্যাচ হয়েছে, চমৎকার আম্পায়ারিং হয়েছে, আমার কাছে কেউ কোন অভিযোগ দেয় নি। যে আম্পায়ারকে নিয়ে কথা হচ্ছে তিনি প্রমাণিত, সামনে বিশ্বকাপ করবেন, আজকেও মাঠে আছেন, আইসিসির ডেভেলপমেন্ট আম্পায়ার তিনি, এখন যদি কেউ বলে থাকে নিয়ে কিছু তাহলে সেটা দুঃখজনক।”
এত আলোচনার পরও দুই দলের কাছ থেকে ভালো আম্পায়ারিংয়ের সার্টিফিকেট পাচ্ছেন সাথিরা জাকির জেসি।
“প্রথমদিকে একটু চাপে ছিল, আপিল হচ্ছিল অনেক, তবে পরে সেটা কাটায়া উঠছে, শুরুর দিকে কিন্তু একটা ডিসিশন গেছে আমাদের বিপক্ষে,” মোহামেডানের তরিকুল ইসলাম বলেন, “কিন্তু ওভারঅল সে ভালো করেছে।”
প্রাইম ব্যাংকও বলছে মাঠে আম্পায়ারিং নিয়ে কোন প্রশ্ন নাই তাদের।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বকাপের দল ঘোষণায় বিলম্ব!!
“কিন্তু কেন এরকম নিউজ, কীভাবে করানো হল জানিনা”-বলেন শিকদার আবুল হাশেম।
ক্লাবটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় “নারী আম্পায়ারের অধীনে ক্রিকেট খেলতে আপত্তি” শীর্ষক সংবাদটি ভিত্তিহীন।
“আমার মনে হয় মিঠুকে (বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান) কেউ মিসগাইড করছে, আমরা কোথাও বলি নাই আম্পায়ার খারাপ করছে বা তাকে কেন দিছে, কিন্তু কিভাবে এটা আসলো জানি না” – বলেন মোহামেডানের ক্রিকেট সমন্বয় তরিকুল ইসলাম।
মুশফিকুর রহিমের আউট নিয়ে যত বিপত্তি
শুরুর দিকে আম্পায়ারিং নিয়ে খানিকটা দ্বিধা থাকলেও সময়মতোই মাঠে গড়ায় খেলা। মিরপুরে টস জিতে ফিল্ডিং বেছে নেয় তামিম, মুশফিকদের প্রাইম ব্যাংক। ব্যাট করতে নেমে মোহামেডান, রনি তালুকদারের ১৪১ রানের ইনিংসে ভর করে তোলে ৬ উইকেটে ৩১৭ রান।
জবাব দিতে নেমে ৩৩ ওভারে ৩ উইকেটে ১৬০ তুলে ফেলে প্রাইম ব্যাংক। এ সময় ১০ রানে ক্রিজে থাকা মুশফিকুর রহিমের একটা ক্যাচ বাউন্ডারি লাইনে নেন মোহামেডানের আবু হায়দার রনি।
তবে সেটি ক্যাচ হয়েছে নাকি ছক্কা তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। যেহেতু খেলাটি সরাসরি টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছিল না, কোন ডিআরএস বা থার্ড আম্পায়ার ছিল না, এরকম ক্ষেত্রে নিয়মটা কি বলছিলেন ম্যাচ রেফারি ও সাবেক ক্রিকেটার রকিবুল হাসান।
“যখন কোন ক্যাচ হয় এবং টিভির সাপোর্ট নেই তখন স্বাভাবিকভাবেই আম্পায়াররা নির্ভর করবে ঐ ফিল্ডারের উপর যিনি ক্যাচটি নেন। তাকে জিজ্ঞেস করবে তুমি কি ক্লিন ক্যাচ নিয়েছো, ঐ ফিল্ডারের কথাই মেনে নিতে হবে, এটাই প্রটোকল, আম্পায়াররা সেটা ভালোভাবেই করেছে।”
কিন্তু আপত্তি আসে প্রাইম ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তাদের দাবি ক্যাচ নিতে গিয়ে ফিল্ডারের পা বাউন্ডারির দড়িতে লেগেছে। এই আউট নিয়ে আপত্তি থাকলেও তারা এখানেও আম্পায়ারের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করে নি।
“মুশফিকের আউট নিয়ে আম্পায়ারও কনফিউজড, ওরা সেলিব্রেশন করতেছে, আম্পায়ার দূর থেকে দেখতেছে, এখানে প্লেয়ারই বলবে। কিন্তু রনি সেটা বলে নাই, আমরা পরিষ্কার দেখছি পা দড়িতে লেগেছে, কিন্তু এখানে আম্পায়ারের আসলে কিছু করার নাই,” – বলেন প্রাইম ব্যাংকের ম্যানেজার।
এসময় বাক বিতণ্ডায় খেলা বন্ধ থাকে প্রায় ১৫ মিনিট। মাঠে প্রাইম ব্যাংকের ক্রিকেটাররা মোবাইলে ফুটেজ দেখিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে এটা আউট নয় ছক্কা। মুশফিকও অনড় দাঁড়িয়ে থাকেন।
মোহামেডানের তরিকুলও বলেন, “ক্যাচটা এক দিক দিয়ে দেখলে মনে হয় পা দড়িঁতে লাগে নাই, আবার আরেক দিকে দেখলে মনে হয় সামান্য একটু লাগছে। এখন এটা তো আম্পায়ার দেবে না, রনি যেটা বলবে সেটাই।”
মাঠে সাথিরা জাকির জেসির সাথে আরেক আম্পায়ার ছিলেন মনিরুজ্জামান। শেষ পর্যন্ত দুজনে মিলে রনির সাথে কথা বলে মুশফিককে আউটের সিদ্ধান্ত দেন।
ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ৩৩ রানে হেরে যায় প্রাইম ব্যাংক, তবে দলটি মনে করে মুশফিকুর রহিম আউট না হলে তারা ম্যাচটি জিততেও পারতো।
কে কী বলছে?
ম্যাচটি কাভার করেছেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক সাব্বির মিথুন। তিনি জানান পুরো ম্যাচে অস্বাভাবিক কিছু তার চোখে পড়েনি।
“আম্পায়ারিং নিয়ে আপত্তি ছিল, তবে কোন পারসোনাল অ্যাটাক হয় নি। কিন্তু ঐ ক্যাচ নিয়েই ঝামেলার শুরু। খেলা শেষে দু’দল আর হাতও মেলায় নি,” বলেন তিনি।
আরেক সাংবাদিক শুভ দেবনাথ সনিও বলেন, “ম্যাচে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, মুশফিকের আউট নিয়ে খেলা বন্ধ ছিল, কিন্তু আম্পায়ারিং ইস্যুতে কিছুই দেখি নি। যে নিউজগুলো হয়েছে বিসিবির বক্তব্য নিয়ে, সেখানে কিন্তু বলা হয়েছে খেলোয়াড়রা না, কর্মকর্তারা আম্পায়ারিং নিয়ে অসন্তুষ্টি জানিয়েছিলেন।
বিসিবির হয়ে এই প্রসঙ্গে একমাত্র কথা বলেছেন আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ।
“দুই দলের ম্যানেজার স্বীকার করেছে যে তারা আম্পায়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তবে সেটা কিন্তু নারী হিসেবে না, অনভিজ্ঞ হিসেবে। কিন্তু আমাদের এই আম্পায়ারকে তো অনেক দিন ধরে প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন ক্রিকেট বোর্ডের পলিসি হল আমরা নারীদের কাজে লাগাবো।“
তিনি বলেন, “আমরা সামনে প্রথম মহিলা রেফারি দিব, এটা একটা প্রসেস, কে পছন্দ করলো না করলো সেটা বিষয় নয়, আমাদের পাইপলাইন তৈরি করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ মাথায় বলের আঘাত, হাসপাতালে ভর্তি মুস্তাফিজুর রহমান!!
বর্তমান ভারত-বাংলাদেশ সিরিজে দায়িত্বে থাকায় সাথীর জাকির জেসির প্রতিক্রিয়া জানা সম্ভব হয় নি।
তবে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারিং মান নিয়ে আলোচনা অনেকদিনের। আম্পায়ারদের প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত এবং ক্রিকেটারদের নাখোশ হওয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে।