করপোরেট বিশ্বে টিকে থাকা এবং প্রভাব বিস্তার করার মূল উৎস হলো ক্ষমতা এবং ক্ষমতার প্রধান উৎস হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অস্ত্রভান্ডারের আধুনিকায়ন। পৃথিবীর ইতিহাসে যারা শাসন করেছে তারা অস্ত্রের জোরেই অন্যায় চাপিয়ে দিয়েছে। সেই উপনিবেশবাদ থেকে পৃথিবী মুক্ত হয়েছে, তবে তার ভাবধারা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের প্রবণতা। এমনকি এই মহাদুর্যোগ করোনার সময়েও এই প্রতিযোগিতা থামেনি। এক এক মহাদেশে কয়েকটি দেশ প্রযুক্তি এবং আর্থিক খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কোনো কোনো দেশ নিজেদের সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে। সবকিছুর ভেতরেই রয়েছে ভোগবাদী প্রবণতা। এর মূলে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এর মধ্যে অন্যতম হলো বহু বছর ধরে দ্বন্দ্বের ঘেরাটপে থাকা আলোচিত দক্ষিণ চীন সাগর। মাঝেমধ্যেই পরাশক্তিগুলো নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতে সেখানে যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এসব নিয়ে তৈরি হয় উত্তেজনা। সম্প্রতি মিত্র দেশগুলোর সাথে নিরাপত্তা সম্পর্ক সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে যাচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় থাকা এ অঞ্চলের আরেক প্রতিবেশী দেশ ভারত। আঞ্চলিক রাজনীতিতে উভয় দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর মাধ্যমে নয়াদিল্লি বেইজিংকে মোকাবিলার আঞ্চলিক রাজনীতিতে আরো বড় ভূমিকার নেওয়ার ইঙ্গিত দিল বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় এ অঞ্চলে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার মিত্রদের কাছে। কোয়াডের চার দেশ যথা—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘কোয়াড’। এই কোয়াড নিয়েই দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের।
আন্তর্জাতিক বিরোধের একটি ইস্যু হলো এই দক্ষিণ চীন সাগর। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এই এলাকা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে? আন্তুর্জাতিক বিরোধের যেসব ইস্যু থাকে তার একটি হলো আন্তর্জাতিক সীমানা এবং সেই সীমানা মেনে চলা ও সেইসাথে ওই অঞ্চল সম্পদ এবং ভূরাজনৈতিকভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার ওপর। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী প্রত্যাহার করার পর হঠাৎ করেই দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছে যে, নিজেদের নৌবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখে। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব মূলত ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও চীনের মধ্যে। ২০১৬ সালে ফিলিপাইনের অনুকূলে দ্য হেগের আদালতের রায়ে বলা হয়, দক্ষিণ চীন সাগরের একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে চীনের অধিকার রয়েছে। তবে গত বছর ওয়াশিংটন দাবি করে, তারা ২০১৬ সালের রায়কে পর্যালোচনা করে দেখেছে যে চীন আইন অমান্য করে এলাকা দখল করছে। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ এককভাবে হুমকি মোকাবিলায় সমর্থ না হলে জোটবদ্ধভাবে তার মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত কোয়াড চীনের মাথাব্যথার কারণ।
সমুদ্র আইন অনুযায়ী কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র তাদের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সামুদ্রিক অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করতে পারে। এছাড়া ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অঞ্চলকে বলা হয় এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন। এখান থেকে তারা মৎস্য আহরণ, প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ ইত্যাদি স্বাধীনতা পাবে। এই অঞ্চলে জড়িয়ে থাকা দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে চীন ওই অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা শুরু করে, যা নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিতে থাকে। প্রত্যেকেই যার যার মতো করে নিজের সুরক্ষায় ব্যস্ত। বিবাদপূর্ণ এলাকাগুলোতে পরাশক্তিগুলো নিজেদের একাধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া। এজন্য তারা মিত্রশক্তি দেশের সাথে মৈত্রিতা স্থাপন এবং একত্রে শক্তির মহড়া দেওয়ার আয়োজন করে। এক্ষেত্রে কোনো দেশই পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। প্রয়োজনে মিত্র দেশের সাথে জোটভুক্ত হয়েও নিজেকে সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত।
দেশগুলো নিজেদের ব্যয়িত অর্থের একটি বড় অংশই অস্ত্র প্রতিযোগিতার পেছনে ব্যয় করছে। দক্ষিণ চীন সাগর হলো প্রশান্ত মহাসাগরের একটি অংশ যার পাশে রয়েছে চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাই। এসব দেশের মধ্যে চীন সবদিক থেকেই শক্তিশালী রাষ্ট্র। যার প্রভাব এ অঞ্চলে বেশি। সীমানা নিয়ে বিরোধও রয়েছে। বিশ্বের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দক্ষিণ চীন সাগর। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে এ পথেই। ফলে এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করা স্বাভাবিক। দক্ষিণ চীন সাগর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ত সামুদ্রিক অঞ্চল। এই অঞ্চল এশিয়ার সাথে আফ্রিকা ও ইউরোপের যোগাযোগ রক্ষা করছে। এসব ছাড়াও দক্ষিণ চীন সাগর সম্পদে ভরপুর। সামুদ্রিক মাছের বিশাল ভান্ডারের সাথে সাথে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এ অঞ্চল। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ সম্পদের বিশাল ভান্ডার। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর)-এর মতে, দক্ষিণ চীন সাগর বিরোধের কারণ হচ্ছে—এর নিচে থাকা ১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস। প্রাকৃতিক বিপুল পরিমাণ সম্পদের দাবিদার এই অঞ্চলের দেশ ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও ভিয়েতনাম, যা নিয়ে চীনের সাথে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। বছরে দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্য দিয়ে আনুমানিক ৩.৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার বৈশ্বিক বাণিজ্য হয়, যা বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ।
২০১৬ সালে বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের শতকরা ৩০ ভাগ পরিবহন করা হয় এই অঞ্চল দিয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস দক্ষিণ চীন সাগর। মৎস্যারোহণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে জড়িত এসব মানুষের জীবন। এসব বিষয় নিয়ে চীনের সাথে বিরোধ ভূরাজনীতিতে প্রায়ই উত্তেজনা তৈরি করে। আর বর্তমানে ক্ষমতার রাজনীতির (পাওয়ার পলিটিকস) প্রবাহে নিজেদের ক্ষমতার প্রসারমাণতা এবং অন্যের কর্তৃত্ব মেনে না নেওয়ায় তীব্র দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে। যে শ্রম, অর্থ কাজে লাগিয়ে মানুষ বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন করেছে কেবল ক্ষমতা জাহির করার জন্য তার জন্য মানুষকে দিতে হয়েছে মানবতা, মানুষেরই চোখের জল, প্রাণ, সম্ভ্রম। আজ সারা বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত রূপ দেখা দিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যদি আরো কোনো বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে এই পৃথিবী নামক গ্রহ আর টিকবে কি না সন্দেহ। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়েও যদি কোনো যুদ্ধের শুরু হয় তা হবে ধ্বংসাত্মক। একলা চল নীতিতে এখন আর আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব না। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার মিত্রদের নিয়ে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করতে চায়। গত বছর ভিয়েতনামের সাথে চীনের বিরোধপূর্ণ অবস্থান শুরু হওয়ার মধ্যেই ভিয়েতনামকে সমর্থন দিতে যুক্তরাষ্ট্র একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। সাগরে ভিয়েতনামের জেলেদের মাছ ধরার অধিকার প্রতিষ্ঠা ও দেশটির আইন প্রয়োগের ক্ষমতা জোরদার করার লক্ষ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। প্রত্যেকেই সামরিক সক্ষমতা বাড়াতেই ব্যস্ত।
আর এশিয়ায় শক্তিমত্তা বাড়িয়ে চলেছে চীন ও ভারত। এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি মোকাবিলায় শিজিনপিংয়ের মেয়াদকালের শুরু থেকেই সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে শুরু করে চীন। দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক স্থাপনা নির্মাণ ও টহলের পরিমাণ বাড়িয়ে এরই মধ্যে তারা তাদের সামরিক অগ্রগতির প্রমাণও দিয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মধ্যে চীন এই অঞ্চলে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ শুরু করেছে। এর ফলে ক্রমেই দক্ষিণ চীন সাগর একটি বৈশ্বিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে চলেছে। যদিও এ উত্তেজনা মাঝেমধ্যেই চলে আসছিল। যেখানে বৈশ্বিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই দক্ষিণ চীন সাগর।