চির নিদ্রায় বাংলা চলচ্চিত্রের রাজপুত্র ‘ওয়াসিম’

আইকোনিক ফোকাস ডেস্কঃ ১৯৫০ সালের ২৩ মার্চ চাঁদপুরে জন্ম নেন মেজবাহ উদ্দিন আহমেহ। তবে তখনো মেজবাহর ওয়াসিম হয়ে ওঠা সময়ের দাবীমাত্র। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে পড়াশোনা করার সময় থেকেই বডিবিল্ডিং এর প্রতি অগ্রহ ছিল। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি বডিবিল্ডিং

১৯৫০ সালের (মতান্তরে ১৯৪৭ সাল) ২৩ মার্চ চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া মেজবাহ উদ্দিন আহমেদের ওয়াসিম হয়ে ওঠার তখনো ঢের বাকি। পড়াশোনা করতেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই বডিবিল্ডিং নিয়ে ছিল তুমুল আগ্রহ। স্কুলে তিনি তুখোড় খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি বডিবিল্ডিংয়ের জন্য ‘মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান’ খেতাব অর্জন করেন। আনন্দ মোহন কলেজে পড়ার সময় থেকেই বডিবিল্ডার হিসেবে লোকে চিনত। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা শেষ করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে।

‘চঞ্চল হাওয়া রে, ধীরে ধীরে চল রে, গুন গুন গুঞ্জনে ঘুম দিয়ে যা রে, পরদেশি মেঘ রে, আর কোথা যাসনে। বন্ধু ঘুমিয়ে আছে, দে ছায়া তারে। বন্ধু ঘুমায় রে…।’ সিনেমার দৃশ্যে গানটি গেয়ে হাত নেড়ে ঘুমন্ত বন্ধুর জন্য মেঘেদের ডাকছেন অলিভিয়া। রুনা লায়লার কণ্ঠে গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন তিনি। গত রাতে অলিভিয়ার সেই বন্ধু চলে গেছেন চিরঘুমে। তিনি রাজপুত্রের বেশে টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলা বাংলা সিনেমার সোনালি যুগের অন্য এক রাজপুত্র, ওয়াসিম। মিষ্টি মেয়ে কবরীর চিরবিদায়ের শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ঢালিউডের স্বর্ণালি যুগের আরেক সুপারস্টার কিছু না বলেই শেষবারের মতো বললেন বিদায়। চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক সাপখোপ, পরি, রাজা-রাজকন্যা, রাক্ষসদের রুপালি জগতের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হিরো ওয়াসিমের এক জীবনে। একইসঙ্গে তিনি সাদাকালো, কিছুটা রঙিন আর রঙিন যুগের হিরো।

তারপর থেকেই নিয়মিত এফডিসিতে আসা–যাওয়া মেজবাহর। অবশ্য অন্য কারণও ছিল। নায়ক খসরু, সোহেল রানা—তাঁদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। একদিন এফডিসিতে ‘ওরা ১১ জন’ ছবির শুটিং দেখতে এসেছিলেন মেজবাহ। একে তো সুঠাম দেহের অধিকারী, উপরি পাওনা হিসেবে ছিলেন সুদর্শন। সেদিন অনেক পরিচালকের নজর কাড়েন সুদর্শন মেজবাহ। প্রায়ই এস এম শফীর শুটিং দেখতে আসতেন মেজবাহ। একদিন এফডিসিতে এলেন সুখবর দিতে। শফীকে বলবেন বলবেন, এমন সময় পরিচালক মোহসিন তাঁকে ‘রাতের পর দিন’ ছবির নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। আর সুখবরটা ছিল, মেজবাহ সেনাবাহিনী থেকে ডাক পেয়েছিলেন। আর তিনি সব সময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে চেয়েছিলেন। সেই খবরই শফীকে দিতে এসেছিলেন এফডিসিতে। তাই সিনেমায় একেবারে নায়ক হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ঠিক কী বলবেন, বুঝতে পারছিলেন না।

শেষমেশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে পরিবারকে না জানিয়েই চুপিচুপি নায়ক হবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। তড়িঘড়ি করে এস এম শফীও তাঁর পরের সিনেমা ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’তে মেজবাহকে চুক্তিবদ্ধ করেন। ‘রাতের পর দিন’ সিনেমার শুটিং শুরুর আগেই পরিচালক মহসিন নাম বদলে রাখলেন ওয়াসিম। আর সেই থেকে মেজবাহ হয়ে গেলেন ওয়াসিম। ববিতাকে সঙ্গী করে বড় পর্দায় তুমুল হিট করল ‘রাতের পর দিন’। এটি ওয়াসিমের প্রথম চুক্তিবদ্ধ ছবি। আর ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’ ওয়াসিমের প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি। এটিও দারুণ ব্যবসাসফল।

ওয়াসিম তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ১৩৩টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেন। ‘রাতের পর দিন’, ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’, ‘বাহাদুর’, ‘আলাদিন আলিবাবা সিন্দবাদ’, ‘নিশান’, ‘দি রেইন’, ‘বন্দুক’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘তুফান’, ‘ঈমান’, ‘দখল’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘বারুদ’, ‘আসামী হাজির’, ‘ওস্তাদ সাগরেদ’, ‘নুরী’, ‘সওদাগর’, ‘গঙ্গা যমুনা’, ‘রাজদুলারি’, ‘আলিফ লায়লা’, ‘আবে হায়াত’, ‘বানজারান’, ‘রঙিন অরুন বরুন কিরণমালা’, ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’, ‘অচল পয়সা’, ‘জীবনধারা’, ‘দিনকাল’, ‘ডাকাত’, ‘মাটির দুর্গ’ উল্লেখযোগ্য। যদিও একটিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নেই এই অভিনেতার। শোনা যায়, ১৯৭৯ সালে ‘ঈমান’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সে বছর কাউকেই সেরা অভিনেতার পুরস্কার দেওয়া হয়নি।

ওয়াসিমের মৃত্যুর পর সামাজিক মাধ্যমে লেখা হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। সেখানে আবেগপ্রবণ ভক্তরা বলছেন, রাজ্জাক, আলমগীর কিংবা জসীম নন; বাংলা সিনেমার সবচেয়ে ব্যবসাসফল নায়ক ওয়াসিম। কেউ কেউ সেটি আবার শতাংশ আকারে প্রকাশ করে লিখেছেন, ওয়াসিমের ৯৮ শতাংশ সিনেমাই নাকি হিট। ওয়াসিম ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিলের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল—অভিনয়ে তুমুল ব্যস্ত ছিলেন ওয়াসিম। দুই দশকে দাপুটে নায়ক হিসেবে পর্দা কাঁপিয়েছেন। আক্ষেপ ছিল, দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মেলেনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের কোনো স্বীকৃতি। সেই আক্ষেপ নিয়ে চলে গেলেন না–ফেরার দেশে। গতকাল দুপুরে বনানী কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।

Leave a Reply

Translate »