বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা গেছে এই জুলাই মাসে। করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড। করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের মধ্যেই এখন মারাত্মক রূপ নিতে শুরু করেছে ডেঙ্গু জ্বর।
চিকিৎসকেরা বলছেন, ইদানীং তারা এমন অনেক রোগী পাচ্ছেন যারা একই সাথে কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
ডেঙ্গু ও করোনার যে পরিস্থিতি এখন
বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে প্রতিদিনই প্রায় দুশোর মতো ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮৭ জন নতুন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার হিসেব করলে এই সংখ্যা অনেক কম মনে হবে।
কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে ২০২০ সালে ১ হাজার ৪০৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, আর চলতি বছরের শুধু জুলাই মাসেই রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ২৮৬ জন।
জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে ৮ গুন বেশি। এখনো পর্যন্ত ঢাকা শহরেই মূলত এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে ঢাকার চারটি হাসপাতালকে শুধু ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
অন্যদিকে এই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ৬ হাজার ৯৪৪ জন মারা গেছেন। আর শুধু জুলাই মাসেই মারা গেছেন ৬ হাজার ১৮২ জন। গত ছয় মাসে মোট ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭৮ জন শনাক্ত হয়েছেন।
কিন্তু শুধু জুলাই মাসেই শনাক্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ নতুন রোগী।
দুটির উপসর্গ বোঝার উপায় কি
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআরের প্রধান ডা. তাহমিনা শিরিন বলছেন, ‘এই দুটো রোগেরই উপসর্গে কিছু মিল রয়েছে। বিশেষ করে আক্রান্ত হওয়ার শুরুর দিকে। কিছুদিন আগেও জ্বর, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা হলেই আমরা বলতাম কোভিড টেস্ট করেন। আমরা এখন যেটা করছি, এসব উপসর্গ দেখলে করোনা এবং ডেঙ্গু দুটোর জন্যই পরীক্ষা করাতে বলছি।’
করোনাভাইরাস থেকে কি ডেঙ্গু সুরক্ষা দেবে?
তবে তিনি বলছেন, আলাদা করে বোঝা যায় এমন লক্ষণও রয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে যেসব উপসর্গ ডেঙ্গুর থেকে আলাদা সেগুলো হচ্ছে, ঘ্রাণ ও স্বাদ চলে যাওয়া, পাতলা পায়খানা, ফুসফুস আক্রান্ত হওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
অন্যদিকে ডেঙ্গুর উপসর্গে পার্থক্যের একটি যেমন চোখের পেছনে ব্যথা, রক্তচাপ কমে যাওয়া। ডেঙ্গু গুরুতর হলে রক্তে প্লাটিলেট কমে যায়, চোখের কোনা, দাঁতের মাড়ি বা নাক থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
পেটের ভেতরে রক্তক্ষরণ হলে মল কালো হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে হঠাৎ মাসিক হয়ে যেতে পারে বা মাসিকের সময় বেশি রক্ত যেতে পারে।
দুটোই একসাথে হলে যে ধরনের জটিলতা হতে পারে
দুটি রোগেরই আলাদা শারীরিক জটিলতা রয়েছে। কিন্তু দুটি রোগে একসাথে আক্রান্ত হলে কি ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে জানতে চেয়েছিলাম রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ভাইরোলজিস্ট ডা. সাবেরা গুলনাহারের কাছে।
তিনি বলছেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে।
‘প্রথম ধরনে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীদের তেমন একটা সমস্যা হয় না। তাদের শুধু জ্বর থাকে। এর পরের গুলো হলেই লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং তা কখনো কখনো জটিল রূপ নেয় যেমন রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যেতে পারে, রক্তক্ষরণ হতে পারে।’, বলছিলেন ভাইরাসজনিত রোগের চিকিৎসক ডা. গুলনাহার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ডেঙ্গু ও কোভিডে একসাথে আক্রান্ত হলে কি হবে।
ডা. গুলনাহার বলছেন, ‘যদি ১ নম্বর ধরনের ডেঙ্গুর পরবর্তী ধরনগুলোর মাধ্যমে কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং একইসাথে কোভিড হয় তাহলে ভয়ের কারণ রয়েছে। কোভিডের কারণে যদি ফুসফুস বেশি আক্রান্ত হয় তাতে রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি কমে যাবে। আবার কোভিড রক্তে যে সমস্যা তৈরি করে তেমন ডেঙ্গুও রক্তে একই রকম সমস্যা তৈরি করে। যাকে বলে ভাস্কুলাইটিস। এসব কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাবে।’
এই দুটি রোগের জটিলতা একসাথে দেখা দিলে দুটোর জন্যে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। বেশি স্টেরয়েড দেবারও রয়েছে বাড়তি ঝুঁকি।
ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল ইসলাম বলছেন, ‘যদি একই সাথে ডেঙ্গুর কারণে রক্তে প্লাটিলেট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি কমে যায় এবং কোভিডের কারণে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রাও ৯০ এর নিচে নেমে যায় তাহলে বিষয়টি বিপদজনক। তখন একই সাথে প্লাটিলেট দিতে হবে, অক্সিজেন দিতে হবে। চিকিৎসকেরা এর সিদ্ধান্ত নেবেন।’
আবার করোনাভাইরাসের কারণে যদি ফুসফুস বেশি আক্রান্ত হয়, হৃদযন্ত্রের আর্টারি আক্রান্ত হয় তখন খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। এমন রোগীদের ফেরানো মুশকিল।
যা করা যেতে পারে
ডা. ইসলাম বলছেন, করণীয় নির্ভর করছে রোগের উপসর্গগুলোর মাত্রা কেমন তার উপরে। যদি উপসর্গ কোনটারই খুব বেশি না থাকে তাহলে চিন্তার কিছু নেই।
মাত্রা ৯০ এর নিচে নেমে যায় কিনা সেটি খেয়াল করতে হবে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা ও রক্তক্ষরণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডা. ইসলাম বলছেন, ডেঙ্গুর ভাইরাস মনোসাইট নামে রক্তের একটি সেলে বৃদ্ধি লাভ করে অন্যদিকে করোনাভাইরাস শ্বাসতন্ত্রে বৃদ্ধি লাভ করে। ডেঙ্গু কখনো ফুসফুস আক্রান্ত করে না।
করোনা ফুসফুসের এপিথিলিয়াল সেলে প্রদাহ তৈরি করে। শরীরের নানা অংশে এই সেলের উপস্থিতি রয়েছে তাই সেখানেও করোনাভাইরাস প্রদাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
ডা. ইসলাম মনে করেন- দুটি ভাইরাস দুইভাবে বৃদ্ধি লাভ করে। তাই দুটো একসাথে মিলে কোন নতুন কোন রূপ বা গণ্ডগোল তৈরি করবে না।
বাংলাদেশে দুটি রোগের একসাথে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নতুন। রোগ দুটি একসাথে হলে সেটি অন্য কোন কিছুতে রূপ নেবে কিনা, বিশেষ কোন অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কিনা সেনিয়ে এখনো যথেষ্ট গবেষণা নেই। হয়ত আরও কিছুদিন গেলে বিষয়টি বিস্তারিত বোঝা যাবে।