জমিনে স্বপ্ন ফলাবেন বলে বুকভরা বিশ্বাস রাখতেন। বিশ্বাসের ঘাটতি রাখেননি কখনোই। চলতি পথে বহুজন মুখ ফিরিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাসে অবিচল থেকেই পথ হেঁটেছেন অনবরত। হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন স্বপ্নের অসীম সীমানা।
আনোয়ার হোসেন। দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান। জাতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার দীর্ঘ পদযাত্রায় ক্লান্তি শেষে চিরবিদায় নিলেন এ ব্যবসায়ী। গত মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
শুরুটা ঠিক কৈশোরেই। যে বেলায় খেলারছলে দিন কেটে যায়, সেই বেলায় তিনি উদ্যোক্তা হয়েছেন। হয়েছেন নামকরা ব্যবসায়ী। নিরলস শ্রম, আত্মবিশ্বাস আর সততায় ভর করে হয়েছেন দেশের বাণিজ্য অঙ্গনের অন্যতম দিকপাল। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করে দেশের উন্নয়নে রেখেছেন বিশেষ অবদান।
আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৮ সালে। পারিবারিক ব্যবসার শুরু ১৮৩৪ সালে। শুরুটা করেছিলেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাক্কু মিয়া (লাট মিয়া)। ওই সময় কুণ্ডু রাজার কাছ থেকে একটি ভিটা ইজারা নেন তিনি। লাট মিয়ার ব্যবসার শুরু হয় শিং দিয়ে চিরুনি আর বোতাম তৈরির মধ্য দিয়ে। আনোয়ার হোসেনের বাবা রহিম বখসের হাত ধরেই ব্যবসার প্রসার ঘটে।
১৯৪৫ সালে বাবা রহিম বখস যখন মারা যান তখন আনোয়ার হোসেনের বয়স সাত বছর। এর ক’বছর পর থেকেই পারিবারিক ব্যবসা সামলাতে সহায়তা করতে থাকেন তিনি। ১৫ বছর বয়সেই ব্যবসা শুরু করেন নিজে। ১৯৫৩ সালের কথা। তার আগে নিজেদের দোকানের পাশেই ভোলা মিঞার দোকানে কাজ শুরু করেন। মাসে ১৫ টাকা বেতনে বড় ভাই তাকে ভোলা মিঞার দোকানে নিযুক্ত করেন। মূলত ব্যবসায় হাতেখড়ি দিতেই এ কৌশল। দুপুর ১টা পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর দোকানের চাকরিতে যেতেন আনোয়ার হোসেন।
এর মধ্যে বড় ভাই ব্যবসা রেখে আনসার বাহিনীতে যোগ দেন। দোকানের দায়িত্ব পড়ে আনোয়ার হোসেনের ওপর। এর কিছু দিন পর বড় ভাই আনসার বাহিনীর চাকরি ছেড়ে ফের ব্যবসায় চলে আসেন। এরপর আনোয়ার হোসেন নিজেই কিছু করার পরিকল্পনা করেন। ভোলা মিঞার দোকানে কাজ করে ৯০ টাকা জমিয়েছিলেন। মা দেন ২০০ রুপার মুদ্রা। মৃত্যুর আগে বাবা রহিম বখস মায়ের কাছে আট ইঞ্চি লম্বা এবং তিন ইঞ্চি পুরু একটি সোনার ইট ও কিছু রুপার মুদ্রা রেখে যান। মা সেগুলো মুরগির খোয়াড়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সন্তানদের হাতে দেননি, যেন তারা অপচয় করতে না শেখেন।
মায়ের দেয়া অর্থ আর নিজের জমানো টাকা মিলিয়ে মোট ৪৮০ টাকায় চকবাজারে ২২০ নম্বর দোকান কিনে নেন আনোয়ার হোসেন। নাম দেন ‘আনোয়ার ক্লথ স্টোর’।
এ ব্যবসাকে বিস্তৃত করার এক পর্যায়ে ১৯৬৮ সালে সিল্ক মিলস প্রতিষ্ঠা করেন। এই মিলেই দ্বিতীয় মেয়ে মালার নামে বাজারে আনেন ‘মালা শাড়ি’। মূলত আনোয়ার তার পরিচিতি মেলে ধরেন এই ‘মালা শাড়ি’র মধ্য দিয়েই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে এক নামে পরিচিতি পেয়েছিল এই শাড়ি। এমনকি এই শাড়ি এতই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, বাজারে অন্য দেশি-বিদেশি শাড়ির বিক্রিবাট্টায় ভাটা পড়ে যায়।
ওই সময় রায়েরবাজারে প্রতি হাটে লুঙ্গির গাঁটকি মাথায় করে নিয়ে যেতেন আনোয়ার হোসেন। পরনের লুঙ্গির ভাঁজে থাকতো মুড়ি-পেঁয়াজি। ‘আমার আট দশক’ শিরোনামে আত্মজীবনী বইয়ে এমনই স্মৃতিমন্থন করেছেন আনোয়ার হোসেন।
ব্যবসায়িক কৌশল আর শ্রমকে ভরসা জেনে বাড়তে থাকে আনোয়ার হোসেনের ব্যবসা। এ সময় চকবাজারেই ছয়টি দোকান কেনেন তিনি। দোকান, কাপড়ের ব্যবসা, ঢেউটিন আমদানি সবই ১৯৬০ সালের আগে শুরু করেন তিনি। দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের করাচিতেও ব্যবসায় সাফল্যের সাক্ষর রাখেন তিনি।
কয়েক দশকের কার্যক্রমে মহীরূহ হয়ে ওঠা আনোয়ার গ্রুপ এখন বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বীমা, আসবাব, অবকাঠামোসহ ৩৬টি পণ্য-সেবাখাতে ব্যবসা করছে। গ্রুপটিতে এখন রয়েছে ২০টি কোম্পানি, যা দেশের শিল্প-বাণিজ্যের বিশেষ বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখছে।
আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী বিবি আমেনার ঘরে চার মেয়ে ও তিন পুত্রের জন্ম। মেয়ে শাহীন বেগম, সেলিমা বেগম মালা, হাসিনা বেগম রুমা এবং শাহনাজ বেগম মুন্নী।
বড় ছেলে মনোয়ার হোসেন দায়িত্ব পালন করছেন আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে। আনোয়ার সিমেন্ট, আনোয়ার স্টিল মিলস, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, মনোয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ এবং সানশাইন ক্যাবলসের ব্যবসা দেখেন তিনি।
মেজ ছেলে হোসেন মেহমুদ দেখছেন হোসেন ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, মেহমুদ ইন্ডাস্ট্রিজ, আনোয়ার সিল্ক, আনোয়ার টেক্সটাইল ও আনোয়ার টেরিটাওয়েলের ব্যবসা।
ছোট ছেলে হোসেন খালেদ দেখাশোনা করেন আনোয়ার জুট মিলস, এজি অটোমোবাইলস, বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিসহ কয়েকটি ব্যবসা।
আনোয়ার হোসেন ১৯৭৩ সালে ধানমন্ডিতে বাড়ি কেনেন এবং পরের বছর পরিবার নিয়ে সেখান ওঠেন। এর আগে পুরান ঢাকার আলমীগোলায় বসবাস করতেন এই শিল্পোদ্যোক্তা।