দেশে চলতি বছরে আলু উৎপাদন বেড়েছে। চলতি মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টন আলু। যা গত বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩০ লাখ টন। করোনার কারণে বিধিনিষেধ থাকায়, চাহিদা কমে যাওয়াসহ নানা কারণে ৪০০ হিমাগারে মজুদ রয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ টন আলু। বাজারদর নিম্নমুখী থাকায় হিমাগার থেকে এসব আলু খালাস হচ্ছে না। এ অবস্থায় চলতি বছর শেষে ২৫ লাখ টন আলু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ)।
বিসিএসএর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২০ মৌসুমে প্রায় ৯০ লাখ টন আলু উৎপন্ন হয়েছিল। চলতি ২০২১ মৌসুমে ১ কোটি ১০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। মূলত অধিক জমিতে আলু চাষ হওয়া, শীতকাল দীর্ঘায়িত হওয়া, আলুর ক্ষেতে রোগবালাই কম থাকা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। মার্চ ও এপ্রিলে দেশের ৪০০ হিমাগারে প্রায় ৫৫ লাখ টন ভোগ্য আলু, বীজআলু, শিল্পে ব্যবহূত আলু ও রফতানিযোগ্য আলু সংরক্ষিত রয়েছে। আগামী দুই মাসে মজুদ আলুর মাত্র ২০ শতাংশ বিপণন হতে পারে। এর সঙ্গে বীজআলুর পরিমাণ বাদ দিলেও হিমাগারে পড়ে থাকবে প্রায় ২৫ লাখ টন।
এদিকে আলুর এ সংকট নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে বিসিএসএ। আলুর সংকট মেটাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারিভাবে আলু কিনে তা ত্রাণকাজে ব্যবহার করা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), ভিজিএফ-ভিজিডি কার্ড এবং ওএমএসের ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে আলু বিতরণের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হিসেবে আলুর ব্যবহার বাড়াতে সরকারিভাবে বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম নিতেও সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে বাড়তি উৎপাদিত আলুর নিরাপদ সংরক্ষণ ও পরবর্তী সময়ে আলুর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হিমাগারগুলোতে আলু মজুদ রাখা হয়। স্বাভাবিক সময়ে আগস্টের মধ্যেই হিমাগার থেকে মজুদ আলুর প্রায় ৮০ শতাংশ বাজারে চলে যায়। আর পাঁচ-সাত লাখ টন বীজআলু মজুদ রাখতে হয়। এর পরও কিছু আলু থাকলে সেগুলো নিয়ে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয় না হিমাগার মালিক, ব্যবসায়ী ও কৃষকদের। কিন্তু চলতি বছর আলুর দাম ও চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে হিমাগার থেকে আলু তুলছেন না কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। তার ওপর রফতানি চাহিদা কমে যাওয়া ও আলুর বিকল্প ব্যবহার না থাকায় বাজারে আলুর চাহিদা এখন প্রায় শূন্যের কোটায়। আলু উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে সরকার পদক্ষেপ নিলেও পণ্যটির বিপণন ও বিকল্প ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগ সীমিত বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই এবার বাড়তি মজুদ নিয়ে হিমাগার মালিক ও কৃষক উভয়ই সংকটের মধ্যে পড়ে গেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোশারফ হোসেন বলেন, হিমাগার থেকে আলু অত্যন্ত ধীরগতিতে বাজারজাত হচ্ছে, যা হতাশাব্যঞ্জক ও উদ্বেগজনক। এর কারণ হচ্ছে লকডাউন। লকডাউনের কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় গ্রামে, শহরে হোটেল গুলোতে আলুর চাহিদা কমেছে। এবার আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে কেজি প্রতি ১৮ টাকা। কিন্তু হিমাগারে বিক্রি হচ্ছে ১২- ১৩ টাকা। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো আলু ব্যবহার হবে না। এ অবস্থায় চলতি বছরে আলু অবিক্রীত ও উদ্বৃত্ত থাকবে।
তিনি জানান, জরুরি ভিত্তিতে আলু রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি খোলাবাজারে ও সরকারি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আলু বিক্রির সুযোগ করে দেয়া প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদে আলুর স্টার্চ, চিপস, ফ্লেক্স ও বিকল্প খাদ্য তৈরিতে শিল্প স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ উদ্বৃত্ত আলুর ব্যবহার সম্পর্কে সময়মতো পদক্ষেপ নেয়া না হলে গত বছরের মতো বাজারে ধস নামবে। ফলাফল হিসেবে আগামীতে কৃষকরা আলু উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবেন। উৎপাদিত উদ্বৃত্ত আলু যেন উদ্বেগের কারণ না হয়, সেজন্য উৎপাদিত আলুর সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে হিমাগার-সংশ্লিষ্টরা আলু রফতানির ওপর জোর দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করেছেন। তারা বলছেন, এ উদ্বৃত্ত আলু সুষ্ঠু ব্যবহারের পদক্ষেপ নেয়া না হলে ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালের মতো প্রান্তিক কৃষক, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও হিমাগার মালিকরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হবেন। আলু উৎপাদনে ব্যয় যেখানে প্রতি কেজিতে ১৮ টাকা। কিন্তু বর্তমানে হিমাগার পর্যায়ে আলুর বাজারদর সংরক্ষণ ভাড়া ও অন্যান্য খরচসহ কেজিপ্রতি গড়ে মাত্র ১৩ টাকা। আলু বাজারজাতের জন্য সময় আছে আর মাত্র চার মাস। এর মধ্যে নিম্নদরের কারণে সংরক্ষিত আলু বাজারজাত করা সম্ভব না হলে বিপুল পরিমাণ আলু অবিক্রীত থাকার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এজন্য আলুকে দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করেছেন হিমাগার মালিকরা।
আলু হিমাগারে থাকলে কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে তার একটা হিসাবও দিয়েছেন হিমাগার মালিকরা। কৃষকের ২৬৯২ কোটি টাকা, হিমাগার মালিকদের ভাড়া বাবদ ১০৩৮ কোটি টাকা এবং ব্যাংকের ২৫০০ কোটি টাকা। আর এই তিন ক্ষেত্রে ২৫ লাখ টন আলুর মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬২৩০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় হিমাগার-সংশ্লিষ্টরা আলু রফতানির ওপর জোর দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করেছেন।
এফবিসিসিআইয়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, ২৫ লাখ টন আলু খালাস না হওয়া সম্ভবনা রয়েছে। আমরা আবেদন করেছি যাতে আলু কিনে ত্রাণকাজে ব্যবহার করা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), ভিজিএফ-ভিজিডি কার্ড এবং ওএমএসের ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে আলু বিতরণের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি জেলখানা, পুলিশ-আনসার, টিসিবি, রোহিঙ্গাদের দেওয়ার জন্য। টিসিবিতে ৩দিন আলু বিক্রির জন্য বলেছি। তবে এখন পর্যন্ত কোন ফলোআপ পাইনি। তবে কৃষিমন্ত্রনালয় বলছে বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছেন।
এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো: ইউসুফ বলেন, আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। ত্রাণ কাজে ব্যবহার করা যায় কিনা। রোহিঙ্গা শিবিরের ইউএনএসিয়ারের সাথে কথা বলেছি সেখানে আলুর ব্যবহার করা যায় কিনা।