পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের একবছর পূর্ণ হয়েছে। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন মেজর সিনহা।
হত্যাকাণ্ডের ১১ মাস পর গত ২৭ জুন ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয়া হলেও করোনার কারণে চলমান বিধিনিষেধে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মামলাটির কার্যক্রমও বন্ধ আছে। আদালত চালু হলে মামলার কার্যক্রম শুরু হবে বলে আদালত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গত বছরের ৩১ জুলাই কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। তখন নিহতের গাড়ি থেকে কিছু ইয়াবা, গাঁজা ও মদ উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ। দায়ের করা হয় একাধিক মামলা। কিন্তু ঘটনার পরদিন থেকে পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট। সিনহা নিহতের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘রাওয়া’। সোচ্চার হয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোও। গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর ৫ আগস্ট নয়জন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন মেজর (অব.) সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার। আদালত মামলাটি আমলে নেয় এবং টেকনাফ থানাকে মামলাটি নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। আসামিরা আদালতে দ্রুত আত্মসমর্পণ করেন। মামলার তদন্তভার পাওয়া এলিট ফোর্স র্যাব হত্যাকাণ্ডের চার মাস দশ দিন পর ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজার আদালতে ২৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেয়। যেখানে ওসি প্রদীপসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলামের দাখিল করা চার্জশিটে সিনহা হত্যার ঘটনাটিকে ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়।
২৭ জুন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন সিনহা হত্যা মামলার চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এছাড়া ২৬-২৭ ও ২৮ জুলাই মামলায় বাদীপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন। ২৬ জুলাই প্রথমদিনের মতো আদালত বাদীপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণের নির্দেশনা দিলেও লকডাউনের কারণে সাক্ষ্য নেয়া যায়নি। এর ফলে সেখানেই আটকে আছে মামলার বিচারকাজ।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘সিনহা হত্যা মামলায় ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তিন দিনে (২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই) ১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু করোনায় ভার্চুয়্যাল আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ থাকায় তাদের সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। মামলায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা আদালতে জামিন চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তবে আদালত তা মঞ্জুর করেনি।
সিনহার বোনের করা মামলার আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘করোনায় আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বর্তমানে মামলার কার্যক্রম থেমে আছে। এছাড়া আর কোনো বাধা নেই। আদালত চালু হলে মামলার কার্যক্রম নিজস্ব গতিতে শুরু হবে।’
মোহাম্মদ মোস্তফা আরও বলেন, ’২৪ জুন পুলিশের সাবেক কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। ঘটনার পর থেকে সে পলাতক ছিল। এই মামলায় সকল আসামি কারাগারে রয়েছেন।’
পুলিশসহ মোট অভিযুক্ত ১৫ জন
সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় র্যাব। তদন্তকারী কর্মকর্তা ৮৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেন। বিভিন্ন ধরনের আলামত ও ডিজিটাল কন্টেন্ট আমলে এনে হত্যাকাণ্ডের মামলায় অভিযোগপত্র দেন তিনি। এতে মোট ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে নয়জন টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্য, তিনজন এপিবিএনের সদস্য এবং তিনজন বেসামরিক ব্যক্তি। তাদের সবাই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১২ জন নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। শুধু ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে জবানবন্দি দেননি।
কারাগারে রয়েছেন যারা
মেজর (অব.) সিনহা নিহতের ঘটনায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমারসহ অভিযুক্ত ১৫ জন আসামিই কারাগারে রয়েছেন। তারা হলেন- টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, কনস্টেবল সাগর দেব, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
তদন্তে যা পাওয়া যায়
গত বছরের ৭ জুলাই সিনহা মো. রাশেদ খান, শিপ্রা দেবনাথ, সিফাত ও রুফতি নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করেন। ইউটিউবে একটি ভিডিও চ্যানেল নিয়ে কাজ করার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। সাধারণ মানুষ পুলিশের মাধ্যমে তাদের জিম্মি দশা, অত্যাচারের ঘটনা মেজর সিনহাকে জানায়। এসব জানতে পেরে সিনহা পীড়িত হন।
তদন্তে আরও জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের কথিত রাজ্য ছিল। মূলত তার স্বেচ্ছাচারিতা, আইন অমান্য করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা এবং তার অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সিনহা ও তার সঙ্গীরা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ওসি প্রদীপ সরকারি অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করতেন এবং ইয়াবাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও র্যাবের অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। এসব বিষয়ে ওসি প্রদীপের কাছে জানতে ক্যামেরা ও ডিভাইসসহ সিনহা, শিপ্রা ও সিফাত থানায় যান।
র্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়, থানায় তাদের অনতিবিলম্বে টেকনাফ বা কক্সবাজার ছেড়ে যেতে বলা হয়। তা না হলে ‘তোমাদের আমি ধ্বংস করে দেব’ বলে হুমকি দেন প্রদীপ। ওসি প্রদীপের হুমকি উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কারণেই ষড়যন্ত্র করে মেজর সিনহাকে হত্যা করা হয় বলে জানায় র্যাব।
ঘটনার দিন সকাল থেকেই সিনহার গতিবিধি নজরে রাখা হয়। একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘বৃক্ষরোপণ’ অনুষ্ঠান শেষে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, মেজর সিনহা রাশেদ প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন। এ সময় সোর্সের মাধ্যমে বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী সিনহার প্রতি নজর রাখতে থাকেন। শামলাপুর এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহা রাশেদকে খুব কাছ থেকে চারটি গুলি করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী।
এর কিছুক্ষণ পরেই প্রদীপ কুমার দাশ যখন ঘটনাস্থলে যান, তখনো মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন। এ সময় ওসি প্রদীপ সিনহার ‘মুখমণ্ডল ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পায়ের জুতা দিয়ে আঘাত করে’ বিকৃত করার চেষ্টা করেন। এরপরই সিনহার মৃত্যু হয়। পরে লোক দেখানোভাবে তাকে একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।