জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরিদর্শক আব্দুর রব। কাজ করছেন সিলেটে। ১৯৯৪ সালে তিনি উচ্চমান টিএ (টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট) পদে চাকরিতে যোগদান করেন। তখন তার সর্বসাকুল্যে মাসিক বেতন ছিল প্রায় ১ হাজার ৬শ টাকা। দুই দফায় পদোন্নতি পেয়ে এখন তিনি পরিদপ্তরের পরিদর্শক। বর্তমান পদে তার মূল বেতন ৩৮ হাজার ৮৯০ টাকা।
বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ এখন সবমিলিয়ে পাচ্ছেন ৫৬ হাজার ৩৯০ টাকা। চাকরির শুরু থেকে গত জুলাই পর্যন্ত চিকিৎসা ও বাড়িভাড়াসহ মোট বেতনভাতা পেয়েছেন প্রায় ৭০ লাখ টাকা। অথচ তিনি বেতন উত্তোলন ৫৭ লাখ টাকার কিছু বেশি। দুর্নীতি দমন কমিশন তার সম্পদ পেয়েছে প্রায় ৭ কোটি টাকার। যদিও বেনামি সম্পদ যুক্ত করলে অন্তত শতকোটি টাকার মালিক তিনি। তার ঘুষের পরিমাণ এতই বেশি যে, বস্তায় ভরে সেই টাকা রাখতে হয় তাকে।
তথ্যসূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর দায়রা জজ ও মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কেএম ইমরুল কায়েস এই আব্দুর রবের সব সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন।
দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যম প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০২ সালের ৯ জুলাই পাংশার পুরান শিকজান মৌজায় ১৭ শতক জমি কেনেন ৯০ হাজার টাকায়। ওই সময় তিনি বেতন পেতেন ২৩শ টাকার মতো। এই হিসেবে দুটি ঈদ বোনাসসহ বছর শেষে তার অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৩২ হাজার টাকার কিছু বেশি। এরপর থেকে তার যতটুকু বেতন ছিলো তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে জমি ক্রয় করতেন। সে থেকে ২০১৮ সালও রাজবাড়ী সদরে ৫৬ দশমিক ৬ শতক জমি কিনেছেন এই পরিদর্শক। যার দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ওই বছর তার বেতন ৩৩ হাজার ৫৮০ টাকা।
বছর শেষে পেয়েছেন ৪ লাখ ৭০ হাজার ১২০ টাকা। ২০১৯ সালে দুদকে তার সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ওই বছরও রাজবাড়ী সদরে জমি কিনেছেন বিপুল টাকার মালিক এই আব্দুর রব। ওই বছর পৃথক তিনটি দলিলে ২২ লাখ ৪ হাজার টাকায় ১ একর ৪৬ শতক জমি কেনেন এই কর্মকর্তা। ২০১৯ সালে আব্দুর রবের বেতন ৩৫ হাজার ২৬০ টাকা। সারা বছরে তার অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪০ টাকা।
মিরপুরের বড় সায়েক মৌজায় ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের নকশায় কল্যাণপুর ২নং প্রজেক্টের বি-১৬ প্লটটির মালিকও আব্দুর রব। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক আব্দুর রব শুধু ঢাকা মহানগর এলাকায়ই ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬৬ টাকার স্থাবর সম্পত্তি অর্জন করেছেন, যা ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত এবং জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে উৎসবহির্ভূত সম্পত্তি।
গত বছরের ৮ জানুয়ারি অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. আবুবকর একই আদালতে আরেকটি আবেদন করেন। এই আবেদনে তিনি বলেন, আব্দুর রবের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ করে বিস্ফোরক আমদানি ও পরিবহণের লাইসেন্স দেওয়া, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে মাসোহারা আদায় করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। তার নিজ নামে রাজবাড়ী, পাংশা ও বালিয়াকান্দিতে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮৫ হাজার ২৫০ টাকার স্থাবর সম্পত্তি অর্জন করেছেন।
আব্দুর রবের এক স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়। সে স্ত্রীকে তিনি তালাক দিয়েছেন। ২৯ জুন তিনি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে এ বিষয়ে একটি অভিযোগ দেন।
বেনামি সম্পদের কথা উল্লেখ করে আব্দুর রবের সাবেক স্ত্রী বলেন, গাজীপুর ও কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে তার টাকায় কেনা সম্পত্তি আছে। ময়মনসিংহে আছে মৎস্য খামার। আছে তেলের লরিও। তার ছোট বোনের স্বামী সুফিয়ার ময়মনসিংহের মাছের খামার পরিচালনা করেন।
সেখান থেকে আরও জানা গেছে, আব্দুর রবকে সামনে রেখে বিস্ফোরক পরিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই পরিদপ্তর থেকে সারা দেশে সিএনজি, এলপিজি ও পেট্রোল পাম্প ছাড়াও জাহাজ কারখানা, গার্মেন্টস, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, অক্সিজেন সিলিন্ডার, গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিস্ফোরক পরিদপ্তর সনদ দেওয়া হয়। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
এক সাক্ষাৎকারে অভিযুক্ত বিস্ফোরক কর্মকর্তা আব্দুর রব তার বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অনেক কিছু অকপটে স্বীকার করেছেন।
বিপুল অঙ্কের টাকার পাশে বসা অবস্থায় ছবি প্রসঙ্গে রব প্রথম সারির গণমাধ্যম প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ‘হ্যাঁ, আমার ছবিই এটা। টাকাগুলো আমার বাসা থেকে বস্তাভর্তি অবস্থায় চুরি করে নেন আমার সাবেক স্ত্রী। এছাড়া চুরি করে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকেও বেশকিছু টাকা চুরি হয়। মান-ইজ্জতের ভয়ে সেই টাকা আর আদায় করতে পারিনি। তবে যা পাওয়া গেছে তা ১৫/১৬ লাখ টাকা হবে।