বন্যা আর ভাঙ‌নে দিশেহারা মানুষগুলো

তা‌লেব আলী মণ্ডল। গত দুই মা‌সে দুবার বসতবা‌ড়ি স্থানান্তর ক‌রে‌ছেন। আগ্রাসী ব্রহ্মপু‌ত্রের বিধ্বংসী রূ‌প বা‌ড়ি সরাতে বাধ্য করেছিল তা‌লে‌ব আলীকে। কিন্তু তারপরেও পিছু ছাড়‌ছে না নদ। দুই মাস মেয়া‌দে অন্যের জ‌মি‌ ভাড়া নি‌য়ে তৃতীয়বা‌রের ম‌তো ঘর সরা‌নোর প্রস্তু‌তি নি‌চ্ছেন তি‌নি।

‘কী করমু বাবা। আর‌ তো পা‌রি না। নি‌জের জায়গা সব গে‌ছে, অন্যের জায়গা ভাড়া নিয়া আছি, নদী সেহানেও থাক‌তে দি‌তা‌ছে না। চারপা‌শে পা‌নি, কই যাই? এই বয়‌সে আর পা‌রি না।’ বল‌ছি‌লেন ষা‌টোর্ধ্ব তা‌লেব আলী।

কু‌ড়িগ্রা‌মের উলিপু‌রের বেগমগঞ্জ ইউনিয়‌নের মোল্লারহাটের দ‌ক্ষি‌ণে ভোগ‌লের কু‌টি গ্রা‌মের বা‌সিন্দা তা‌লেব আলীর অস্থায়ী বা‌ড়ির ঠিক উত্ত‌রে চল‌ছে তীব্র ভাঙন। সেখানকার বা‌সিন্দা বিছা শেখ। ১৫-২০ দিন আগে বা‌ড়ি স‌রা‌লেও ভাঙ‌নের কব‌লে আবারও নদীর কিনা‌রে  তার বাড়ি। অস্তিত্ব রক্ষায় তাই আবারও বা‌ড়িঘর স‌রি‌য়ে নি‌চ্ছেন তি‌নি।

বিশা শেখ ব‌লেন, ‘নদী‌তে মাছ মাইরা জীবন চালাই। মা‌ঝে মা‌ঝে মজু‌রি বেঁ‌চি। দিন আইনা দিন চল‌তে হয়। এর ম‌ধ্যে বারবার বা‌ড়ি সরানো লাগ‌লে কেম‌নে বাঁ‌চি। নি‌জের জ‌মিজমাও নাই, পোলাপান নিয়া কই গিয়া দাঁড়াই!’

শুধু তা‌লেব আলী কিংবা বিছা শেখ নয়, ভাঙ‌নের কব‌লে সর্বস্বান্ত হ‌চ্ছে তার প্রতি‌বে‌শীসহ ৬ ও ৭নং ওয়া‌র্ডের শতা‌ধিক প‌রিবার। ভাঙ‌নে ন‌দের গ‌র্ভে চ‌লে গে‌ছে ইউনিয়‌নের উত্তর বালা‌ডোবাসহ মোল্লারহা‌টের বেশ কিছু অংশ। এর ওপর বন‌্যায় নাকাল হ‌য়ে‌ মান‌বেতর জীবন যাপন কর‌ছে এই ইউনিয়‌নের শত শত প‌রিবার।

ধারণক্ষমতার অতি‌রিক্ত জলরা‌শি উগ‌রে দি‌য়ে অববা‌হিকার বা‌সিন্দা‌দের পা‌নিব‌ন্দি ক‌রে ক্ষ্যান্ত হ‌চ্ছে না ব্রহ্মপুত্র। তীব্র ভাঙ‌নে ভি‌টেমা‌টি হা‌রি‌য়ে বাস্তুহারা হ‌চ্ছে একের পর এক প‌রিবার। বেঁ‌চে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় এক চর থে‌কে আর এক চ‌রে স্থানান্ত‌রিত হ‌তে হ‌তে বিপর্যস্ত হ‌য়ে পড়‌ছেন ভুক্ত‌ভোগীরা। সহায়তা তো দূ‌রের কথা সহমর্মিতা দেখা‌তেও কাউকে পা‌শে পা‌চ্ছেন না তারা।

বিছা শেখ জানান, তার ম‌তো আরও প্রায় একশ’ প‌রিবার ভাঙন হুম‌কি‌তে আছে। তা‌দের দায় কেউ নেয় না। চেয়ারম্যান কিংবা জনপ্রতি‌নি‌ধি কেউই সহায়তার হাত বা‌ড়ি‌য়ে পা‌শে দাঁড়ান না। উদ্বাস্তুর ম‌তো জীবন তা‌দের।

স্থানীয় বা‌সিন্দা মিজানুর রহমান জানান, ব্রহ্মপু‌ত্রের ভাঙ‌নে বিলীন হ‌চ্ছে একের পর এক আবা‌দি জ‌মি, বস‌তিসহ বি‌ভিন্ন স্থাপনা। কিন্তু ভাঙন প্রতি‌রো‌ধে কোনও ব্যবস্থা নেই। তিনি ব‌লেন, ‘ভাঙন থাম‌ছে না। এলাকার একের পর এক প‌রিবার বসত‌ভিটা হারা‌চ্ছে। আমার নি‌জের এক‌টি কলাবাগান ভাঙ‌নে ন‌দের গর্ভে চ‌লে যা‌চ্ছে।’

বেগমগঞ্জ ইউনিয়‌নের চেয়ারম্যান বেলাল হো‌সেন জানান, গত এক বছ‌রে তার ইউনিয়‌নের ক‌য়েকশ’ প‌রিবার বাস্তুহারা হ‌য়ে‌ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ‌কে বারবার বলার পর তারা প‌রিদর্শনে গে‌লেও ভাঙন প্রতি‌রোধ কিংবা ভুক্ত‌ভোগী‌দের পুনর্বাস‌নে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়‌নি।

চেয়ারম্যান ব‌লেন, ‘গত এক বছ‌রে অন্তত পাঁচ শতা‌ধিক বা‌ড়িঘর ব্রহ্মপু‌ত্রের ভাঙ‌নে বিলীন হ‌য়ে‌ছে। এখনও ভাঙন চলমান। এলাকার ছয়টি ওয়া‌র্ডে ভাঙন চল‌ছে। কিন্তু বন্যা বা ভাঙনকব‌লিত‌দের কারও হা‌তে এখনও কোনও সহায়তা‌ পৌঁ‌ছে দেওয়া সম্ভব হয়‌নি।’

Leave a Reply

Translate »