ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সি খুলে বিদেশ পাঠানোর নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। তাদের প্রতারনায় নিঃস্ব বিদেশগামীরা।
আল আরাফাত ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর নামের ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সির মালিকসহ দুজনকে আটকের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিকেশন (পিবিআই)। ভুয়া এ এজেন্সির মালিক জহিরুল ইসলাম নিজেকে উপ-সচিব পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করতেন।
পিবিআই বলছে, রাজধানীতে এ রকম অর্ধশত একটি সিন্ডিকেটের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। আর বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতারিত হলে পিবিআইয়ের কাছে অভিযোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।
বুধবার (১৮ আগস্ট) রাজধানীর বনশ্রীতে পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানান পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নামে তিন থেকে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। অনেকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পর কথিত অফিস বন্ধ করে দেয়। রাজধানীর গুলশানের ইউনিকর্ন প্লাজায় এই চক্রের অফিসের ঠিকানা থাকলেও বর্তমানে সেখানে তাদের কোনো শাখা বা অফিসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, এ সিন্ডিকেটের ১৫ থেকে ২০ জনের সংঘবদ্ধ চক্রের মধ্যে অনেকে নিজেকে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তারা চলাফেরা করে দামি গাড়িতে। ভিজিটিং কার্ড বানিয়ে সহজেই মানুষকে বোকা বানিয়ে আসছিল। তারা সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা বলেও বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়।
মিজানুর রহমান বলেন, এই প্রতারক চক্রের সাথে জড়িত অন্যান্য আসামি ও অজ্ঞাতনামা আরো প্রতারক মিলে ‘আল-আরাফাত ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর’ নামে ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নামে তিন থেকে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ রকম আরো ভুয়া প্রতিষ্ঠান নজরদারির মধ্যে রয়েছে। যারা বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন তাদের পিবিআই অথবা সংশ্লিষ্ট থানায় অেভিযোগ করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।
পিবিআই জানায়, এ ঘটনায় গত ৩১ জুলাই রামপুরা থানায় একটি মামলা করা হয়। আর সেই মামলার সূত্র ধরে আল আলারাফত নামের এ ভুয়া এজেন্সির উপ-সচিব পরিচয় দেওয়া প্রতারককে আটক করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা : চক্রটি বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার প্রথম ধাপ শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী অফিসও খুলে এ প্রতারক চক্র। এরপর পর্যায়ক্রমে তারা ক্লায়েন্টদের নিকট থেকে টাকা নিয়ে এক সময় উধাও হয়ে যায়।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, এ রকম ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সি যারা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করে আসছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কিছুদিন আগে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা বিদেশগামীদের প্রতারণা করে আসছিল।
তিনি বলেন, সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে হংকং পাঠানোর নামে প্রতারণা করে আসছিল একটি সিন্ডিকেট। তাদের দুজনকে আমরা গ্রেপ্তার করি। এই দুজন প্রথমে বিজ্ঞাপন দেয়। এরপর তাদের দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে তারা পরবর্তী ফাঁদ পাতে। তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে লাখ লাখ টাকা হারিয়েছেন অনেকে।
তিনি জানান, বিজ্ঞাপন দেখে এই প্রতারকদের দেওয়া ফোন নম্বরে কেউ কল করলে হংকংয়ে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখাত তারা। অথচ তাদের নিজস্ব কোনো অফিস নেই। তারা অফিস না থাকার বিষয়টি আড়াল করে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দেখা করত যমুনা ফিউচার পার্কের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। সেখানেই হংকং পাঠানোর জন্য মৌখিক চুক্তি করত। এরপর চুক্তি অনুযায়ী টাকা নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিদেশ না পাঠিয়েই লাপাত্তা হতো তারা।
ভুক্তভোগীদের বর্ণনা : পত্রিকায় ‘ভিসা প্রসেসিং’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। যেখানে হংকংয়ের কিছু ভিসা প্রসেস করা হবে বলে জানানো হয়। যোগাযোগের ঠিকানা দেওয়া হয় উত্তরা, হাউজ বিল্ডিং, ঢাকা। সঙ্গে দেওয়া ছিল একটি ফোন নম্বর। সেই নম্বর দেখে যোগাযোগ করেন নারায়ণগঞ্জের জিয়াউল হক সুমন ও হায়াত আহম্মদ। তাদের সঙ্গে প্রতারকরা দেখা করে যমুনা ফিউচার পার্কের রেস্টুরেন্টে। হংকং পৌঁছার পর প্রত্যেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে দিতে হবে বলে মৌখিক চুক্তি হয়।
‘ফ্লাইটের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৪ সেপ্টেম্বর। নির্ধারিত তারিখে যাত্রার আগে মোটা অঙ্কের একটা টাকা ডলারে এক্সচেঞ্জ করা হয়।
ফ্লাইটের দিন দুই ভোক্তভোগী যে টাকা হংকং গিয়ে দেওয়ার কথা ছিল, তা থেকে আট হাজার ডলার প্রতারকদের দিয়ে দেন। এরপর প্রতারকরা তাদের দুজনকে বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করতে বলে। তারা একটু পর আসার কথা বলে ১ নং টার্মিনালের দিকে চলে যায়। এরপর আর ফিরে আসেনি। কিছুক্ষণ ফোনে আসছি-আসছি বললেও কিছুক্ষণ পর মোবাইল ফোন বন্ধ করে তারা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।’
একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন গাইবান্ধার মামুনুর রশীদ। তিনিও বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে চার লাখ টাকা হারিয়েছেন।
তিনি বলেন, বিজ্ঞাপন দেখে নম্বরে যোগাযোগ করি। হংকংয়ে চাকরি অফার পেয়ে চার লাখ টাকার চুক্তি হয়। একইভাবে বিমানবন্দরে আসার পর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফোনে ও কোথাও প্রতারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে প্রতারণার শিকার হয়েছি, বিষয়টি বুঝতে পারি।
এদিকে যাচাই-বাচাই ছাড়া পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপানো ও বিজ্ঞাপন দেখে ফাঁদে পা না দেওয়ার অনুরোধ জানান সিআইডি কর্মকর্তা মোল্লা নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপন ছাপানোর ক্ষেত্রে একটু সতর্ক হয়ে, যাচাই-বাচাই করে ছাপানোর ব্যবস্থা থাকলে প্রতারকরা এ সুযোগ নিতে পারবে না।
আর যারা বিজ্ঞাপন দেখেই সরল বিশ্বাসে ফাঁদে পা দিচ্ছেন, তাদেরও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির দেওয়া তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পরই চুক্তি বা লেনদেনে যাওয়া উচিত। তাহলেও এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, অনুমোদন দেওয়ার আগে ও পরে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম নজরদারিতে রাখা জরুরি।
কারণ, দেশের শতকরা আশিভাগ এজেন্সি লাইসেন্স নিয়ে জনশক্তি রপ্তানির নামে অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। জাল ভিসা ও পাসপোর্ট দিয়ে মানবপাচার করে তারা। যারা তাদের হাতে প্রতারিত হন তাদের অনেকেই অভিযোগ করেন না। কার কাছে কোথায় অভিযোগ করলে প্রতিকার পাওয়া যাবে সেই বিষয়টিও অনেকের অজানা। ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্সি ও তাদের দালালরা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করেন।