ধারণা করা হয়- পুরো পৃথিবীর ৩ শতাংশ মানুষ যমজ। এই ৩ শতাংশ নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোনো শেষ নেই। চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী, দুটি শুক্রাণু একসঙ্গে দুটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করলে ভ্রাতৃসুলভ যমজ সন্তানের জন্ম হয়। এরা ফ্যাটার্ন্যাল টুইন নামেও পরিচিত।
সাধারণভাবে দেখা যায় যে, ভ্রাতৃসুলভ যমজের ক্ষেত্রে দুটি সন্তানের চেহারা হুবহু দেখতে একইরকম না, ভাইবোন যেমন হয় বা বোন-বোন বা ভাই-ভাই যেমন হয় সেইরকম। স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যগতভাবেও তারা কিছুটা ভিন্ন হয়। কিন্তু দুটি শুক্রাণু একসঙ্গে একই ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্ত হয়ে সমান দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যে যমজ সন্তানের জন্ম হয় তারা আইডেন্টিক্যাল টুইন নামে পরিচিত। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হুবহু একইরকম দেখতে। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও অনেকটা একইরকম।
আজকাল বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা আগের চেয়ে অনেক বেশি। প্রতি ৬৫ জনে একজন মায়ের সাধারণ প্রক্রিয়াতেই দুটি যমজ সন্তান হতে পারে। মায়ের পরিবারের কেউ যমজ থেকে থাকলে এর সম্ভাবনা বেশি। আবার মায়ের বয়স বেশি বা ৩০-৩৫ এর মধ্যে হলেও যমজ বাচ্চা হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এছাড়া বর্তমানে চিকিৎসার অগ্রগতির কারণে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার জন্য যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয় যেমন-আইভিএফ, এ ধরনের চিকিৎসার মাধ্যমেও এখন যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে গেছে।
এজন্য শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই যমজ সন্তান জন্মানোর হার আগের চেয়ে বেশি। তবে যমজ সন্তান গর্ভে ধারণ করলে মা ও সন্তানের কিছু কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যেমন-গর্ভবতী মায়ের শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়া, প্রেসার বেড়ে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, অপরিণত ও কম ওজনের শিশু, বাচ্চার জন্মগত ত্রুটিসহ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ, গর্ভকালীন সঠিক পরিচর্যা এবং সতর্কতার মাধ্যমে এ ধরনের সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
রাহ এবং সাহির বয়স এখন ৮ মাস। একদিকে দীর্ঘ ৭ বছর পর সংসারে সন্তানের আগমন সেই সাথে যমজ সন্তান হওয়ায় পরিবারটিতে এখন খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কথা হয় যমজ সন্তানের মায়ের সঙ্গে।
তিনি বলেন, এত বছর পর একসাথে দুই সন্তানের মা হওয়ার এই আনন্দ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ওদের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে যেতে পারি। ওদের কিছু কাজে আমি খুব মজা পাই। যেমন খাবার দিতে একটু দেরি হলে বড়টার দিকে তাকালে খুব জিদ দেখায়। কিন্তু ছোটটার দিকে তাকালে ও হেসে দেয়। আমি ওদের ছড়া শুনালে ওরা দু’জনই এখনই তা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে।
তিনি বলেন, সাধারণ গর্ভবতী মায়েদের তুলনায় গর্ভে যমজ সন্তান থাকলে খাবারদাবারের ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো যেমন পর্যাপ্ত খেতে হবে, তেমনি পর্যাপ্ত ডায়েটও মেনে চলতে হবে। গর্ভবতী মাকে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। গর্ভকালীন জটিলতাগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পাশাপাশি নেটে সার্চ দিয়েও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। যেটা আমি করতাম। এখনো বাচ্চাদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে নেটে সার্চ দিয়ে জেনে নেই। গর্ভবতী মাকে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে এবং নিয়মিত চেকআপ করতে হবে।
সন্তান লালন-পালন করা অভিভাবকদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। দুটি সন্তান একসাথে লালন-পালনের ক্ষেত্রে স্বভাবতই চ্যালেঞ্জটা দ্বিগুণ। তাই যমজ শিশুর পরিচর্যার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন—
বুকের দুধ পান করানো
মা ও পরিবারের অন্যদের ধারণা যে, যমজ দুই সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় বুকের দুধ মা দিতে পারবে না। এটা ভুল। মা যদি সবার সহযোগিতা পান, যমজ এমনকি একসঙ্গে তিন নবজাতক সন্তানকে পূর্ণ ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধের পুষ্টি বজায় রাখতে সক্ষম থাকেন। এক্ষেত্রে সামলানো সম্ভব হলে একসঙ্গে দু’জন শিশুকেও স্তন পান করাতে পারেন।
শিশুর খাবার
ছয় মাস বয়সের পর যখন শিশুকে বুকের দুধের বাইরে অন্য খাবার দেওয়া শুরু করবেন তখন দু-তিন ঘণ্টা পরপর খাবার দিন। দু’জনই সমপরিমাণে খাবার খাবে না এটাই স্বাভাবিক। বকাঝকা করবেন না। প্রয়োজনে খাবারের মেন্যু বদলে দিন।
ঘুমের সময়
যমজ বাচ্চা হলেই যে দু’জনে একসঙ্গে সব কিছু করবে এমন ভাবার কারণ নেই। হয়তো একজন ঘুমাল, অন্য শিশুটি হাত-পা মেলে খেলা করতে পারে। ঘুম পাড়ানোর জন্য জোর না করে তাকে সময় দিন, প্রয়োজনে কোলে করে একটু হাঁটুন।
আলাদা বিছানা
এক শিশুর কোনো কারণে অসুখ হলে অন্যজনের মধ্যেও তা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই একজন কোনো রোগে আক্রান্ত হলে অপরজনকে আলাদা বিছানায় রাখুন।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা
যেহেতু শিশুরা খুব অল্পতেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়, তাই শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে বাইরে থেকে কেউ ঘরে ফিরলে বা বাড়িতে অতিথি এলে সে যেন হাত ভালোমতো না ধুয়ে, পোশাক না বদলে শিশুকে স্পর্শ না করে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখুন।
আরও যেসব বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন
– যমজ সন্তানদের কখনো যমজভাবে চিন্তা না করে, তাদের দুজনকে আলাদা ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দিয়ে বড় করে তুলুন। যেমন প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে জন্মদিনের উপহার বা পার্টির ব্যবস্থা করা।
– যমজ সন্তানের রেষারেষি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামাল দিন।
চাই পরিবারের সহযোগিতা
যমজের যত্ন নিতে স্বভাবতই প্রত্যেক বাবা-মাকে হিমশিম খেতে হয়। এক্ষেত্রে পরিবারের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
যমজ সন্তানের মা সাবরিনা আহমেদ রিমি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া যমজ সন্তান লালন-পালন করা অনেক কষ্টসাধ্য। আমি সৌভাগ্যবান আমি যৌথ পরিবারে থাকি এবং আমার স্বামী, শ্বশুর, ননাস এমনকি ননাসের বাচ্চারাও আমার বাচ্চাদের দেখাশুনা করে। এতে আমি অনেকটা সময় বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পাই। রাতে ওদের ঘুম ভেঙে গেলে আমার স্বামী এবং আমি ভাগাভাগি করে ওদের সময় দেই। এতে আমার ঘুমের খুব বেশি ব্যাঘাত ঘটে না। আমি একজন কর্মজীবী নারী এবং ছুটি শেষে আমাকে আবার কর্মস্থলে ছুটতে হবে। কিন্তু আমি এ নিয়ে চিন্তিত নই। কারণ আমার সন্তানদের দেখভালের জন্য আমার পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন। আসলে এ সুযোগটা প্রতিটি নতুন মায়ের বিশেষ করে যমজ সন্তানের মায়ের জন্যই অপরিহার্য। কারণ এ সময় শিশুর সুস্থতার জন্য মা-বাবা দু’জনেরই সুস্থ থাকা দরকার। মা-বাবার পর্যাপ্ত খাওয়া ও বিশ্রাম প্রয়োজন। একা সন্তান মানুষ করলে তা অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। তাই যমজ সন্তান লালন-পালন করতে অবশ্যই পরিবারের সদস্যদের পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন। যাদের সেই সুযোগ নেই তাদের প্রথম থেকেই অন্যকারও সহযোগিতা কিভাবে নেয়া যায়- সেটা ভেবে দেখতে হবে।