বিশ্বজুড়ে অসংখ্য নিরাপত্তা ও কূটনীতি বিশেষজ্ঞকে চমকে দিয়ে তালেবান ঝড়ের গতিতে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গত কয়েকদিন ধরে পশ্চিমা দেশগুলো তড়িঘড়ি সেখান থেকে তাদের কূটনীতিক ও নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে, ছেড়ে যাচ্ছেদুই দশকের কর্মস্থল ও বিনিয়োগ।
অবশ্য কেবল তাদের ক্ষেত্রেই নয়, তালেবানের এ পুনরুত্থানে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতেও বড় ধরনের পালাবদল দেখা যেতে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে কট্টর ইসলামিক গোষ্ঠীটির ফের ক্ষমতারোহণ ভারতকে নতুন পরীক্ষায় ফেলবে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
নয়া দিল্লির সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক আগে থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ; তার ওপর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের সীমান্ত বিরোধও এখন তুঙ্গে। এ দুটি দেশই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের সঙ্গে অরক্ষিত দীর্ঘ সীমান্ত থাকা পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই তার উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশীকে নিয়ে চলা রাজনৈতিক দাবাখেলার সক্রিয় খেলোয়াড়। এখন চীনও আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে এই খেলায় বড় ভূমিকা পালন করতে চায়।
দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গত মাসে জ্যেষ্ঠ তালেবান নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যা বোঝাচ্ছে বেইজিং আর ওই অঞ্চলে নীরব খেলোয়াড় হয়ে থাকতে চায় না।
“সম্ভাব্য এই ভূরাজনৈতিক পুনর্গঠনে সবকিছু উল্টেপাল্টে যেতে পারে,” বলেছেন আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় দায়িত্বপালন করা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায়।
আফগানিস্তানকে ঘিরে কাবুলের গণতান্ত্রিক সরকার, পশ্চিমা বিশ্ব এবং ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটি জোড়াতালি দেওয়া বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু বিশ্ব সম্ভবত এখন খেলার পরবর্তী পর্বে পাকিস্তান, রাশিয়া, ইরান ও চীন কেমন খেলে, তা দেখতে যাচ্ছে।
অনেকে আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানকে দিল্লির পরাজয় আর পাকিস্তানের ‘বড় জয়’ হিসেবে দেখলেও সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক জিতেন্দ্র নাথ মিশ্র একে এত সরলভাবে দেখতে নারাজ। তার মতে, পশতুন-নেতৃত্বাধীন তালেবান কখনোই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের এখনকার সীমান্তকে স্বীকার করে নেয়নি, যা ইসলামাবাদের জন্য অস্বস্তিকর।
“পাকিস্তান এখন চাইবে তালেবান যেন সীমান্তকে মেনে নেয় এবং এটাই তাদের অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে স্থান পেতে যাচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
তবে এরপরও আফগানিস্তানে তালেবান শাসন যে পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে এগিয়ে রাখবে, সেটাও অস্বীকার করা যাবে না বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
“ইসলামাবাদ তাই পেয়েছে, যা সে অনেকদিন ধরে চাইছিল। আফগানিস্তানে এমন একটি সরকার, যাকে তারা সহজেই প্রভাবিত করতে পারবে,” বলেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের উপপরিচালক মাইকেল কুগেলমেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে মাখামাখি আর সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানির সঙ্গে ইসলামাবাদের কুসুম কুসুম সম্পর্কে সন্তুষ্ট ছিল না পাকিস্তান। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটও তাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সব মিলিয়েই ইসলামাবাদ এখন নিজেকে বিজয়ী মনে করতে পারে, কেননা চীনের সঙ্গে তাদের ‘সব ঋতুর’ বন্ধুত্বকে এখন আফগানিস্তানে কাজে লাগানো যাবে। অন্যদিকে বেইজিংও এখন আর তার প্রতাপ দেখাতে লজ্জা পায় না।
“চীন এখন তার নিজস্ব নিয়মেই এই খেলা খেলতে পারে এবং তারা খেলবেও,” বলেছেন জিতেন্দ্র মিশ্র।
আফগানিস্তানে চীনেরও স্বার্থ আছে, তারা তাদের বাড়তে থাকা খনিজের চাহিদার খানিকটা এখান থেকে মেটাতে পারে। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তারা তালেবানকে ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টকে (ইটিআইএম) নিষিদ্ধ ঘোষণার চাপ দিতে পারবে।
আফগানিস্তানের ভূমি থেকে পরিচালিত এই সংগঠনের বিরুদ্ধে শিনজিয়ানের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টির দায় দিয়ে আসছে বেইজিং।
গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছেন, চীন ও পাকিস্তান এখন ‘আফগানিস্তানে একে অপরের পিঠে চড়ে এগিয়ে যেতে পারবে’।
তবে এতে খুশিতে না ভেসে, বেইজিংয়ের উচিত হবে অতীতে বিশ্ব শক্তিগুলো আফগানিস্তানে যেভাবে ফাঁদে পড়েছে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা, বলেছেন তিনি।
রাশিয়া ও ইরানও আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানে লাভবান হবে। এ দুই দেশের কাউকেই কাবুলের দূতাবাস খালি করতে হয়নি, তাদের কূটনীতিকরা এখনও দেশটিতে নির্বিঘ্নে কাজ করছেন।
এই পরিস্থিতিতে ভারত কী করবে? দেশটি কখনোই রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো আফগানিস্তানকে ঘিরে চলা খেলার বড় খেলোয়াড় ছিল না।
নয়া দিল্লি সবসময় আফগানিস্তানের সঙ্গে নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় আগ্রহী ছিল; পড়াশোনা, কাজ ও চিকিৎসার জন্যও হাজার হাজার আফগান নাগরিককে ভারতে যেতে হয়।
মিশ্র বলছেন, ভারতের হাতে এই মুহুর্তে ভালো কোনো বিকল্পই নেই।
“আছে খারাপ এবং তারচেয়েও খারাপ বিকল্প,” বলেছেন তিনি।
তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে কি দেবে না, তা নিয়েই ভারতকে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে; বিশেষ করে মস্কো ও বেইজিং যেহেতু কোনো না কোনোভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে।
ইসলামাবাদও সম্ভবত তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবেই মেনে নেবে, যেমনটা তারা করেছিল ১৯৯৯ সালেও।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারতের হাতে এখন সবচেয়ে সেরা উপায় হচ্ছে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের পথ খোলা রাখা। যদিও তালেবান ও দিল্লির মধ্যে ইতিহাস আমলে নিলে, এ ধরনের কোনো সম্পর্কই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশটির জন্য স্বস্তিদায়ক হবে না।
১৯৯৯ সালে একটি ভারতীয় উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছিনতাইকারীদের নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল তালেবান সরকার। ওই ঘটনা এখনও ভারতীয়দের স্মৃতিতে থেকে যাওয়ার কথা।
এর বাইরেও দিল্লির সঙ্গে সবসময়ই তালেবানবিরোধী আফগান যুদ্ধবাজ নেতাদের জোট নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
কিন্তু এখন যেহেতু কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে, ভারত এখন তার নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে অতীতকে একপাশে সরিয়ে রাখার কথা ভাবতে পারে।
তালেবানের সাফল্য জইশ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তৈয়বার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোকে উদ্দীপ্ত করতে পারে এবং তারা ভারতের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা ও তা কার্যকর করতে পারে, এমন উদ্বেগও রয়েছে।
ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক ও আফগানিস্তান বিষয়ক একটি বইয়ের লেখক অমলেন্দু মিশ্র বলছেন, ভারতকে এখন বেশ সতর্কতার সঙ্গেই পা ফেলতে হবে। বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর যেন মুজাহিদীনদের পরবর্তী আখড়া না হয় তা নিশ্চিতে কৌশলও ঠিক করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালেবানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী কোনো জোট যদি গড়েও ওঠে, তবে তাদের সঙ্গে নয়া দিল্লির ঘনিষ্ঠতা কতখানি হবে, সে বিষয়েও ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পশ্চিমা বিশ্ব খুব সম্ভবত তালেবানকে চপে রাখতে খুব শিগগিরই একটি ‘ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ গঠন করতে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তালেবান সরকারের মোকাবেলায় যৌথ প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য এরই মধ্যে আহ্বানও জানিয়েছেন।
এর বাইরেও নানা ধরনের সম্ভাবনা আছে। নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের পুনরেকত্রীকরণে দেরি হতে পারে কিংবা আফগানিস্তান হয়ে উঠতে পারে পশ্চিমা বিশ্ব ও চীন-রাশিয়া-পাকিস্তানের যৌথশক্তির মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ, তা প্রমাণের অন্যতম লড়াইক্ষেত্র।
সব মিলিয়ে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে এ পটপরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের হাতে সোজাসাপ্টা কোনো পথ খোলা নেই; তবে তাদের সিদ্ধান্ত যে আঞ্চলিক শান্তি ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করবে, তা নিশ্চিত।