মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় মানুষ ভুল করে। আর কিছু মানুষ ওঁৎপেতে বসে আছে, মানুষের অবচেতন মনের ভুলগুলো নিয়ে খেলাচ্ছলে কারণে-অকারণে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ট্রল ও উপহাস করতে। ট্রল সংস্কৃতি তুমুল বেগে সমাজ জীবনে আঘাত করেছে। যা ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোট-বড়, উঁচু-নিচু, শ্রদ্ধেয়-অশ্রদ্ধেয় কারো তোয়াক্কা করে না। করোনাকালে মারাত্মক দানবীয় আকৃতিতে দেখা দেয় ট্রল সংস্কৃতি। কোনো মানুষের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক ও উপহাসপূর্ণ বাক্যব্যয় ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। নিঃসন্দেহে ট্রল করা ভয়াবহ গুনাহের কাজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম।’ (সূরা হুজরাত আয়াত : ১১)
আজকাল হরহামেশাই মানুষের ট্রল করার প্রবণতা দেখা যায়। বন্ধু মহলের আড্ডায়; দুর্বল বন্ধু কে, ক্লাসে ফাঁকিবাজ ছাত্রছাত্রীদের, খেলার মাঠে, কাজ করার ধরণ দেখে, আকার-আকৃতির ওপর ভিত্তি করে, রসিকতা করে ব্যঙ্গ নামে ডাকে মজা করে। কিন্তু ট্রল এক ধরনের গিবত। মানুষ হেসে খেলে ভয়ংকর গুনাহের কাজে নিজেকে যুক্ত করছে। ফেসবুকের কোন বিষয় যাচাই-বাছাই না করে মানুষ লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বুদ্ধি ও প্রজ্ঞায় হেরে গোপন বিষয় ভাইরাল করে ঘায়েল করার ফন্দি আঁটে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোনো কোনো অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু।’ (সূরা হুজুরাত আয়াত : ১২)। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রধান থেকে শুরু করে নিচুতলার মানুষেরও ট্রল সংস্কৃতির ছোঁয়া লেগেছে।
দুনিয়া কাঁপানো এক ভাইরাস। আঘাতেই প্রাণের উচ্ছ্বাস হারিয়ে, কোটি প্রাণ হয় নিষ্প্রাণ। সুবিশাল আকাশের নিচে হাজারও অরণ্যের ভিড়ে মানুষ অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অক্সিজেন শূন্য হয়ে মরে। তবুও মানুষ বিপর্যস্ত জীবন থেকে পরিত্রাণের পথ না খুঁজে, অনুতাপহীন মনে ট্রল করে নিত্যনতুন বিষয়ে। করোনা টেস্ট, শনাক্ত রোগীর আচরণ, টিকা প্রদান নিয়ে ট্রলের সীমা নাই। কঠোর লকডাউন, শাটডাউন আসছে, সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালু, বিধিনিষেধ মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে সব খোলা এসব নিয়ে হেয়ালিপনার অন্ত নাই। ত্রাণ বিতরণ, রাজনৈতিক ইস্যু, মিডিয়া পাড়া নিয়ে ট্রল করা নতুন কিছু নয়। মহানবী (সা.) উপহাসকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘একজন উপহাসকারীর জন্য বেহেশতের দরজা খুলে দেয়া হবে এবং তাকে বলা হবে; ‘এস’। সে তার দুঃখ ও অসহায়ত্ব নিয়ে সামনে অগ্রসর হবে এবং যখন সে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইবে তখনই তার সামনে বেহেশতের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।’ (কানজুল উম্মাল : ৮৩২৮)
ট্রল সংস্কৃতি হলো কুৎসিত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। অনেকেই সমালোচনার নাম ভাঙিয়ে ট্রল করে। সমালোচনা করা যাবে না এমনটা নয়, তবে সেটা যেন হয়; সংশোধনের করার উদ্দেশ্যে। যারা নিছক বিনোদনের জন্য ট্রল করে তারা জানে না, আল্লাহ সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর কেউ অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও সে দেখবে।’ (সূরা যিলযাল আয়াত : ৮)। ভরা মজলিসে কারোর ওপর লজ্জা ও অপমানজনক বাক্য বর্ষণ করতে পারলে আনন্দের হাসি হেসে কুটিকুটি হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ব্যঙ্গ বাক্য শুনে বিধ্বস্ত হয়ে লজ্জায় মুখ লুকায়। ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্যই এটি মন্দ কাজ, যার ফলে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। মুমিনদের উচিত ট্রল সংস্কৃতি পরিহার করা।
ইসলাম মানুষকে উন্নত মননশীল তৈরি করে। মুমিনগণ অপর মুমিন ভাইয়ের আয়না স্বরূপ। কোনো মুমিন ভাইয়ের চেহারায় ভুলে কালির আঁচড় পড়লে অপর মুমিন ভাই মুছে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কোনো মুমিন মনের ভুলে দোষত্রুটি করে ফেললে তবে অপর মুমিন গোপন করতে মহাপ্রাচীরের ভূমিকা পালন করে এবং ভুল সংশোধনের জন্য একাগ্রতা সহকারে চেষ্টা করে। হে আল্লাহ! আমাদের ট্রল সংস্কৃতি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন।