টাওয়ার অব সাইলেন্স ইয়াজদে ইরানের একটি ঐতিহাসিক সংরক্ষিত শহর।এখানে আছে মাটির স্থাপত্য কাদা-ইটের ঘর এবং বিস্ময়কর প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ। এই প্রাচীন শহরটি বহু শতাব্দী জুড়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আবাসস্থল ছিল এবং ফলস্বরূপ এখানে অনেক মসজিদ, উপাসনালয় এবং জোরোস্ট্রিয়ান মন্দির আছে।
ধীরে ধীরে ইসলাম এখানকার প্রধান ধর্ম হয়ে উঠেছে, কিন্তু এখনও সেখানে জোরোস্ট্রিয়ানের সাথে সম্পর্কিত অগ্নি মন্দির এবং অন্যান্য স্মৃতিসৌধ রয়েছে। জুরোস্ট্রিয়ানিজম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম এবং এটি প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্ম বলে বিশ্বাস করা হয়। এটি বর্তমান ইরানের পার্সিয়ায়। একসময় জারথুশ্রার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানকার আকর্ষণীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি হলো টাওয়ার অব সাইলেন্স বা নীরবতার মিনার। এটি ইয়াজদের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে একটি পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত একটি ৮ মিটার বৃত্তাকার কাঠামো। জোরোস্ট্রিয়ান বিশ্বাসের অনুসারীরা এই স্থানটিকে মৃতদেহ সৎকারের কাজে ব্যাবহার করতো।
ছাদবিহীন কাঠামোকে স্থানীয় লোকেরা ‘দাখমেহ’ বলে। এই কাঠামোগুলি ছাদবিহীন রাখার কারন হলো এতে করে শিকারী পাখিরা ঝাপ দিয়ে ভিতরে ঢুকতে এবং বের হতে পারে। এই স্থাপত্যটি তিনটি এককেন্দ্রীয় দেয়াল দিয়ে গঠিত। বাইরের সারিটি পুরুষদের জন্য ব্যবহৃত হ’ত। কেন্দ্রীয় অশংটি মহিলাদের জন্য এবং একদম অভ্যন্তরের অংশটি শিশুদের মৃতদেহ রাখার জন্য ব্যাবহার করা হ’তো। শকুনরা মৃতদেহের মাংস খেয়ে ফেলার পরে মৃতদেহের হাড়গুলি রাখার জন্য এই কাঠামোর মাঝখানে একটি কূপ আছে, হাড়গুলি সেখানে রাখা হ’ত। প্রাচীন জোরোস্ট্রিয়ান বিশ্বাস মতে শারীরিক দেহের মৃত অংশগুলি কাটা চুল এবং কাটা নখের মতন অপরিস্কার এবং অপবিত্র।
অধিকন্তু শারীরিক বিশুদ্ধতার সাথে আধ্যাত্মিক পবিত্রতার ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। এবং আত্মা দেহ ত্যাগ করার সাথে সাথে এটি দূষিত হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটির দূষিত প্রভাব আধ্যাত্মিকভাবে বিপজ্জনক হিসাবে বিবেচিত হয়। ফলস্বরূপ জোরোস্ট্রিয়ান লোকেরা মৃতদেহ যতটা সম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করে। এছাড়াও, জোরোস্ট্রিয়ানদের মতে আগুন, পৃথিবী, বায়ু এবং পানি এই চারটি ‘পবিত্র’ উপাদানকে যেকোনও সংক্রামক থেকে পরিষ্কার রাখতে হবে। এই কারণে, মৃতদেহ সরাসরি পৃথিবীতে সমাহিত করা বা পুড়িয়ে ফেলার পরিবর্তে বরং তারা তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য অন্য পদ্ধতি প্রয়োগ করে।
প্রথমে তারা মৃতদেহটি ষাঁড়ের প্রস্রাব দিয়ে ধুয়ে ফেলে এবং এর পরে মৃতদেহটি যেই স্থানে রাখা হয়েছিলো সে স্থানও ধুয়ে ফেলে। এরপরে ভূতদের ধরে রাখার জন্য একটি কুকুরকে মৃতদেহের কাছে নিয়ে আসা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ‘সাগদিদ’ নামে পরিচিত। জোরোস্ট্রিয়ান অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে এটি একটি অপরিহার্য অংশ। এরপরে মৃতদেহ কাপড় দ্বারা আবৃত করেপাথর বা মাটির অগভীর গর্তের উপর রাখা হত। দর্শনার্থী এবং মৃতদেহের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে এবং মন্দ শক্তিগুলি দূরে রাখার জন্য আধ্যাত্মিক বাধা হিসাবে মৃতদেহের চারপাশে কয়েকটি বৃত্ত আঁকা হ’ত। এই আচার অনুষ্ঠানে আগুন একটি পবিত্র উপাদান হিসাবে কাজ করে এবং সুগন্ধী কাঠ জ্বালিয়ে জেরোস্ট্রিয়ানবাসীরা জায়গাটিকে রোগ এবং দূষণ থেকে পরিষ্কার রাখত।
অনুষ্ঠানের এই অংশটি কেবল দিনের বেলাতেই করতে হয় এবং মৃতদেহ বহনকারীদের সংখ্যা সর্বদা সমান হতে হবে। তিন দিন ধরে,পরিবার এবং বন্ধুরা মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য প্রার্থনা করবে এবং যে বাড়িতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান হয়েছে সেখানে মাংস খাওয়া এবং রান্না করা যাবে না। শিকারী পাখিরা মৃতদেহ খেয়ে পরিস্কার করে ফেলবে, এইভাবে অপরিষ্কার দেহটি অদৃশ্য হয়ে যেতো এবং বাকী হাড়গুলি কাঠামোর কেন্দ্রে অবস্থিত কূপে ফেলে দেয়া হতো। এই প্রক্রিয়া প্রায় ৩০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ছিল।
১৯৭০ এর দশকের পরে এই ঐতিহ্য ইরানে অবৈধ হয়। বর্তমানে এই ধরনের কোন অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হয় না এবং সরকার জোরোস্ট্রিয়ান সম্প্রদায়কে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য অন্যান্য পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্য করতে বাধ্য করে। তাদের মধ্যে অনেকেই দূষন এড়ানোর উপায় হিসাবে কংক্রিটের নীচে মৃতদেহ সমাহিত করে। এই টাওয়ারটি এখন আর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় না বরং এটি এখন পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে একটি আধুনিক জুরোস্ট্রিয়ান কবরস্থান এবং কিছু অন্যান্য পরিত্যক্ত ভবন এবং মন্দির রয়েছে। প্রাচীন ধর্ম এবং রীতিতে আগ্রহী লোকদের কাছে এই জায়গাটি বেশ জনপ্রিয়। ভারতেও পার্সী সম্প্রদায় রয়েছে। মুসলিম আরবরা পার্সীয়া আক্রমণ করলে অনেক জুরোস্ট্রিয়ান ভারতে পালিয়ে যায়। ভারতে প্রচুর জুরোস্ট্রিয়ান ধর্ম বিশ্বাসীরা বসবাস করে। ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে পার্সী জনসংখ্যা প্রায়,৬১,০০০, এর মধ্যে ৪৫,০০০ ই মুম্বাইয়ে বাস করে। ভারতের মুম্বাইতে টাওয়ার অব সাইলেন্স রয়েছে।