আইকোনিক ফোকাস ডেস্কঃ হিজরি নববর্ষ ১৪৪৩ সমাগত। হিজরি সন চান্দ্র মাস পরিক্রমায় আবর্তিত হওয়ায় মুসলমানের জন্য এই সনের তাৎপর্য ব্যাপক। হজ, জাকাত ও রোজাসহ ইসলামের বহু বিধান ও আচার-অনুষ্ঠান চাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হিজরি সনের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রীতি-প্রচলনের নানা দিক তুলে ধরা হলো-
নববর্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো মুসলিমরীতি। অথচ শুভের ধারণা অশুভের বিপরীতে অর্জিত হয়। ফলে ‘অশুভ’ অবিশ্বাস নিয়ে শুভ বিষয়ে বিশ্বাস সন্দেহ সৃষ্টি করে। কেননা বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে ‘আনলাকি থার্টিন’ কিংবা অশুভ বিনাশ করে শুভের আগমনের একটি ধারণা আছে। ইসলামে অশুভ ও কুলক্ষণের কোনো চর্চা নেই; বরং আছে শুভ ও কল্যাণের ধারণা। আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি আর কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই। তবে ‘ফাল’ (শুভ লক্ষণ) আমাকে আনন্দিত করে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ফাল’ কী? তিনি বলেন, ‘উত্তম বাক্য’।
অর্থাৎ সুন্দর শব্দ ও উত্তম বাক্য শুনে মনে মনে কল্যাণের আশা পোষণ করা বৈধ। এ জন্য নবীজি (সা.) কারো অনর্থক কিংবা নেতিবাচক নাম শুনলে অর্থবোধক ইতিবাচক নামে পরিবর্তন করে দিতেন। কারো অভিবাদনের জবাবে তিনি একটু বাড়িয়ে শুভকামনা জানাতেন। মূলত, এটা পবিত্র কোরআনের শিক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন তোমাদের অভিবাদন করা হয়, তখন তোমরাও তার চেয়ে উত্তম অভিবাদন কোরো অথবা তারই অনুরূপ কোরো।
হিজরিবর্ষ মূলত চান্দ্র বর্ষ, যা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। এটি পৃথিবীতে বর্ষ গণনায় চাঁদনির্ভর একমাত্র বর্ষপঞ্জি এবং চাঁদ রাতে উদিত হয় বলে রাত দিয়ে তা শুরু হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলুন, এটা মানুষ এবং হজের জন্য সময়-নির্দেশক।
আল্লাহ আরো বলেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে নিশ্চয়ই মাসগুলোর সংখ্যা হলো ১২। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।
ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সূর্যকে দীপ্তিময় ও চাঁদকে আলোকময় করেছেন এবং তার জন্য কক্ষপথ নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো।
দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর সময়কালে বসরার গভর্নর আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফার কাছে এক পত্রে লেখেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আমাদের কাছে বহু পত্র আসে, যাতে তারিখ লেখা থাকে শাবান। কিন্তু তা কি বর্তমান বছরের, নাকি অতীতের-আমরা বুঝতে পারি না। তারপর ওমর (রা.) সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন ওমর (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি পরামর্শ সভার আহ্বান করেন। সভায় সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের বছর, তালহা (রা.) নবুয়তের বছর, আলী (রা.) হিজরতের বছর থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। তারপর তাঁরা সবাই আলী (রা.)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন।
সন গণনা শুরুর জন্য নবীজি (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, নবুয়ত ও হিজরত-চারটি প্রস্তাব এসেছিল। বস্তুত জন্ম ও নবুয়তের সন নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। আর মৃত্যু শোকের স্মারক। তাই অগত্যা হিজরতের মাধ্যমেই সাল গণনা শুরু করা হয়। (ইবনে হাজার আসকালানি, ফাতহুল বারি : ৭/২৬৮)। নবীজি (সা.)-এর হিজরত ২৭ সফর থেকে শুরু করে ১২ রবিউল আউয়াল অবধি সম্পন্ন হয়েছিল। বর্ষ গণনার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১৭তম বছরের ১০ জুমাদাল উলা মাসে। মাস হিসেবে রবিউল আউয়াল কিংবা জুমাদাল উলা কোনোটি থেকে বর্ষ গণনা শুরু হয়নি। সমকালীন আরবে মহররম ছিল প্রথম মাস। পরিস্থিতি বিবেচনায় শৃঙ্খলা রক্ষার্থে তা অপরিবর্তিত রাখা হয়।
নববর্ষের চাঁদ দেখে মুসলিমরা আনন্দিত হবে এবং নতুন চাঁদ দেখার দোয়া পড়বে-এটাই স্বাভাবিক। তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) যখন নতুন চাঁদ দেখতেন তখন এই দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ। নবী জীবনের আদর্শ অনুসরণের জন্য কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি বছরব্যাপী সিরাত-সাহিত্য অধ্যয়নের পরিকল্পনা নিতে পারে। নববর্ষে হোক জীবনকে ঢেলে সাজানোর নতুন আত্মপ্রত্যয়।