শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান সাধারণ ছুটি আরেক দফা বাড়তে পারে। সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের বেশি এবং সংশ্লিষ্টদের টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় এমনই চিন্তাভাবনা চলছে। তবে বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর মাসেই সচল হচ্ছে। শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে বিভিন্ন বর্ষ ও সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংস্পর্শে যাওয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত করার চিন্তা চলছে। পাশাপাশি নভেম্বর ও ডিসেম্বরে নির্ধারিত এই দুটি পরীক্ষা (এসএসসি-এইচএসসি) সরাসরি নেওয়ার সিদ্ধান্তও প্রায় চূড়ান্ত। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান সোমবার বিকালে বলেন, সংক্রমণ প্রত্যাশিত হারে নেমে আসার পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের টিকা দেওয়া শেষ হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসবে। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিত মানদণ্ড বলে দেওয়া আছে। এছাড়া শ্রেণিকক্ষের পাঠদান উন্মুক্ত করতে সবাইকে টিকা দেওয়ার কাজও শেষ করা প্রয়োজন। এ দুটি সন্তোষজনক পর্যায়ে না এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা অনেক মাস প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছি। সংক্রমণ প্রত্যাশিত হারে নেমে আসতে বা টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করতে আর হয়তো ৫-৬ সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা হয়তো কষ্টকর হবে না বলে মনে করি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৩১ আগস্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি চলবে। ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে দাবি সবচেয়ে বেশি জোরালো। এই পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে দেওয়ার নির্দেশনা দেন।
সোমবার (২৩ আগস্ট) অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয় বলে সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
পাশাপাশি তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রোগ্রাম (কর্মসূচি) ঠিক করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আজকেও কথা হয়েছে। তারা প্রোগ্রাম ঠিক করছে-কীভাবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে জানাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। এখন কেবল সহনীয় পরিবেশ-পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছি।
এর আগে গত ১৮ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। পরিস্থিতি অনুকূল হওয়া মাত্রই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়-প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা একাধিক বিকল্পসহ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে রেখেছে। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা হচ্ছে, উচ্চতর থেকে নিচের দিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধাপে ধাপে খোলা হবে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় সচল হবে। এটা শুরু হবে পরীক্ষা কার্যক্রম দিয়ে। স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়ার ফাঁকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করা হবে। পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংক্রমণ নেমে এলে বিশেষ করে টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজে ক্লাস কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেওয়া হবে। পাশাপাশি খুলে দেওয়া হবে আবাসিক হল।
ডব্লিউএইচও’র মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে সংক্রমণ ৫ শতাংশে নেমে এলে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সোমবারও দেশে বর্তমানে সংক্রমণের হার ছিল সাড়ে ১৫ শতাংশ, আর করোনায় মারা গেছেন ১১৭ জন।
খোলার প্রস্তুতি : সূত্র জানায়, সরকার উচ্চতর পর্যায় থেকে ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। টিকা দেওয়া শেষ হলে সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার চিন্তাভাবনা। ক্লাস শুরুর অন্তত এক সপ্তাহ আগে আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া হবে। এছাড়া পরিবহণ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস-মাইক্রোবাস ইত্যাদি চলাচলের উপযোগী করা হবে। নাম প্রকাশ না করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন সদস্য জানান, অন্তত দুই সপ্তাহ আগে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণা আসবে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত এবং নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিলেও এতবড় ঘোষণা দেওয়ার আগে সরকারের সঙ্গে উপাচার্যদের বৈঠক হবে। সেখানেই বিস্তারিত রোডম্যাপ হবে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেপ্টেম্বরেই সচল হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজে ১ সেপ্টেম্বর থেকে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৮ সেপ্টেম্বর থেকে মাস্টার্সের স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে। এভাবে অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটি পরীক্ষা নিচ্ছে, আবার কোনোটি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে।
এদিকে এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও সরাসরি নেওয়ার কথা ভাবনায় আছে বলে জানিয়েছেন কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব। তিনি জানান, আশা করছি, নভেম্বরের আগে সংক্রমণ কাঙ্ক্ষিত হারে নেমে আসবে এবং টিকা দেওয়ার কাজও শেষ হবে। তাই এই দুটি পরীক্ষা সরাসরি নেওয়া যাবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারাও একই কথা জানিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে এসএসসির প্রশ্নপত্র জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো শুরু হয়েছে। সেখান থেকে প্রশ্নপত্র উপজেলায় পাঠানো হবে। এই পরীক্ষা আগামী নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নেওয়ার কথা আছে। আর শিগগিরই এইচএসসির প্রশ্নপত্র ছাপানো শুরু হবে। এই পরীক্ষা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নেওয়ার কথা আছে।
টিকাদান পরিস্থিতি : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সংক্রমণ ৫ শতাংশে নেমে আসার বিষয়টি অনিশ্চিত এবং প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এ কারণে টিকা দেওয়ার প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। গত ৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন লাখ ৬৩ হাজার ২২২ শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। তাদের মধ্যে দুই লাখ ৭৮ হাজার ৪২৬ জন টিকা নিয়েছেন। বাকি আছেন প্রায় ৮৪ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধিত ৩৪ হাজারের বেশি শিক্ষকের মধ্যে ৩০ হাজার টিকা পেয়েছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এক লাখ ৭৯ হাজার ২৬১ শিক্ষার্থী টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। যাদের মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ৭৯ হাজার ৯১৪ জন। আর উভয় ডোজ পেয়েছেন ছয় হাজার ৭২ জন।
ইউজিসির সচিব (দায়িত্বপ্রাপ্ত) ড. ফেরদৌস জামান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ শতাংশ শিক্ষকই টিকা পেয়েছেন। অন্যদিকে সাম্প্রতিক গণটিকা কার্যক্রমে নিবন্ধিত বেশির ভাগ শিক্ষার্থী টিকা পেয়েছেন। আমরা আশা করছি, সেপ্টেম্বরের মধ্যে সবাই টিকার আওতায় চলে আসবেন।