জহির রায়হান। এই কালজয়ী চলচ্চিত্রকার ও শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের ৮৭তম জন্মদিন আজ। এ দেশের চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি তিনি। লেখক, সাংবাদিক, পরিচালক, প্রযোজক। দেশে এবং বিদেশে জহির রায়হান নামটাই তাকে চিনে নেবার জন্য যথেষ্ট। তার রহস্যময় অন্তর্ধানের পর তাকে নিয়ে এবং তার সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে লেখা ও গবেষণা হয়েছে বিস্তর। এখনো তিনি আছেন লেখায়, আলোচনায়, গবেষণায়।
১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার মজুপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরো নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম ছিল জাফর। মানুষের কাছে জহির রায়হান নামেই বিখ্যাত। তার বাবার নাম মোহাম্মদ এমদাদউল্লাহ এবং মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। বাবা ছিলেন একজন আইন ব্যবসায়ী।
রাজনৈতিক নানা অস্থিরতা তাকে নাড়া দিতো । ১৯৪৫ সালে ভিয়েতনাম দিবস এর মিছিলে জহির রায়হান অংশ নেন। ছাত্র জীবনে রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার জেলে গিয়েছেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম ১০ জনের যে দলটি ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল, জহির রায়হান তাদেরই একজন। ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানেও জড়িত ছিলেন।
তিনি চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন ১৯৫৭ সালে। উর্দু ভাষার ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। এ ছাড়াও ‘বাহানা’, ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’ তা নির্মিত কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ আজো ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘বাহানা’। ১৯৭১ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেন কালোত্তীর্ণ প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। তার প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্কগ্দুন, বরফ গলা নদী। শিল্প-সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নিগার চলচ্চিত্র পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমির মরণোত্তর সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।
তার চলচ্চিত্রগুলো এখনো বিশাল একটা জায়গাজুড়ে আছে বাঙালির মনে । আর তার কিছু লেখাতো অমর হয়ে আছে। তার একটি কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’। পরে এই উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ন করেন তারই সহধর্মিনী অভিনেত্রী কোহিনূর আকতার সুচন্দা। তার প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী সুমিতা দেবী। এই প্রয়াত অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই নাট্য নির্মাতা। স্ত্রী সুচন্দার ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগত ও জীবনমুখী সাহিত্য ধারায় জহির রায়হানের অবদান অনেক । তার খ্যাতি চলচ্চিত্রের জন্য হলেও শুরুটা কথা সাহিত্যিক হিসেবে। তিনি অবশ্য অনেক কাজের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। তার সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে।‘যুগের আলো’ পত্রিকায়। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে ‘প্রবাহ’ নামের একটি পত্রিকায় যোগ দেন।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অগ্রজ সাংবাদিক শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের সন্ধানে বেরিয়ে নিখোঁজ হন জহির রায়হান। ধারণা করা হয়ে থাকে, মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে থাকা মিরপুরে শহীদ হন তিনি। তবে তার লাশের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় মিরপুরে বিহারী এলাকায় ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলির আঘাতে তিনি মারা যান।